যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পবিত্র ধর্মবোধ থেকে দান করা হয় জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে, সেগুলো ব্যাপকভাবে বেদখল, আত্মসাৎ ও লুটপাটের কবলে পড়তে পারে; তা সহজে বিশ্বাস হওয়ার নয়। কিন্তু দেশে ওয়াক্ফ এস্টেটগুলোর ক্ষেত্রে তাই ঘটছে। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার শাহপীর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন আহমদুর রহমান ওয়াকফ স্টেটের জমি নিয়ে হরিলুট চললেও এই ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন মতোয়াল্লী জান্নাত আরা বেগম। দরবেশিয়া শাহী জামে মসজিদের জন্য ওয়াকফকৃত এসব জায়গা মসজিদের কল্যাণে ব্যবহার হওয়া তো দূরের কথা উল্টো নানা অনিয়মের কারণে এই স্টেট বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৩১ সালের ২৯ আগষ্ট বিশিষ্ট সমাজসেবক ও দানবীর আহমদুর রহমান নিজ নামে ‘আহমদুর ওয়াকফ স্টেট’ বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে নিবন্ধন করেন। এই ওয়াকফ স্টেটে মোট জমির পরিমাণ ৬ কানি ৭ গন্ডা, যার ইসি নং- ১৩৪১১। নিবন্ধন শর্তে বলা হয় উক্ত জমি দরবেশীয়া শাহী জামে মসজিদের খেদমতের জন্য এবং পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে মতোয়াল্লী নিযুক্ত থেকে এই ওয়াকফ স্টেট পরিচালনা করবেন। ওয়াকফকৃত জমি বয়-বিক্রি করা যাবে না, করলে তা অগ্রাহ্য হবে। নিঃসন্তান আহমদুর রহমানের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাতিজা মৃত ইসমাইল সরকারের ছেলে আকতার আহমদ সরকার মতোয়াল্লীর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। আকতার আহমদ সরকারের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে মোঃ নূরুচ্ছফা মতোয়াল্লীর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ২০০৯ সালে নূরুচ্ছফার মৃত্যু হলে ওয়াকফ প্রশাসনের নীতি বহির্ভূতভাবে নূরুচ্ছফার স্ত্রী জান্নাত আরা বেগম মতোয়াল্লীর দায়িত্ব নেন। যদিও মতোয়াল্লীর দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য উপযুক্ত ওয়ারিশ অর্থাৎ আকতার আহমদ সরকারের সৎ ভাই মৃত হারুন সরকারের ৫ ছেলে রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নীতি বহির্ভূতভাবে জান্নাত আরা বেগম মতোয়াল্লীর দায়িত্ব নেন।
অনুসন্ধানে গিয়ে আরো দেখা যায়, ওয়াকফকৃত ৬ কানি ৭ গন্ডা সম্পত্তির মধ্যে ওয়ারিশদের পুকুর ও বসবাস স্থানের জন্য ১ কানি ৭ গন্ডার মত জমি দখলে থাকলেও অবশিষ্ট ৫ কানি জমির কোন অস্তিত্বই পাওয়া যায় নি। লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওয়াকফ স্টেটের প্রায় সব সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। কিছু সম্পত্তি ওয়ারিশরা বেআইনিভাবে বিক্রি করলেও বেশীর ভাগ সম্পত্তি স্টেডিয়াম ও প্রভাবশালী মহলের দখলে চলে গেছে। সব মিলিয়ে এই ওয়াকফ স্টেটের সব জমি এখন বেহাত হয়ে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, মতোয়াল্লী জান্নাত আরা বেগম শুধুমাত্র পুতুল হিসেবে দায়িত্বে আছে। সবকিছু চালায় হারুন সরকারের বড় ছেলে আবু তাহের ও নেজাম উদ্দিন। এই কারণে আবু তাহের ও নেজাম উদ্দিনের সাথে অন্য ভাইদের দ্বন্দ্ব চরমে।
মৃত হারুন সরকারের বড় ছেলে আবু তাহের বলেন, এই ওয়াকফ স্টেটের বর্তমান মতোয়াল্লী সম্পর্কে আমার ভাবী হন। তিনি স্টেট পরিচালনায় অদক্ষ হলেও তার চাইতে যোগ্য কেউ নাই। মতোয়াল্লী হিসেবে তিনি নিজেকে উপযুক্ত মনে করেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, মতোয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা আগে থাকলও এখন নেই। বর্তমান মতোয়াল্লীকে সরানোর জন্য আমি আবেদন করতে গিয়ে দেখি আমার ভাই শাহজাহান আগেই আবেদন করেছেন। এখন এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাই না, আমি স্টেটের কোন সুবিধাভোগীও নই। আমার ভাই শাহজাহানের মধ্যে মতোয়াল্লী হওয়ার যেই ইচ্ছা রয়েছে তা কখনো পূরণ হতে দিবো না। তার চাইতে বর্তমান মতোয়াল্লীর হাতে স্টেট অনেক ভালো আছে।
এবিষয়ে আবু তাহেরের ছোট ভাই শাহজাহান বলেন, আমার পূর্ব পুরুষ মরহুম আহমদুর রহমান ছিলেন একজন দানবীর ও সমাজসেবক। মসজিদের খেদমতের জন্য সমস্ত সম্পত্তি ওয়াকফ করে দিয়েছেন। কিন্তু একজন তথাকথিত মতোয়াল্লী জান্নাত আরা বেগম দায়িত্ব নিলেও তাঁকে পরিচালনা করেন আমার বড় ভাই আবু তাহেরসহ আরো কয়েকজন দূর্নীতিবাজ লোকের একটা সিন্ডিকেট। তারা সিন্ডিকেট করে স্টেটের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে অতি সুকৌশলে।তাদের সহযোগিতায় প্রভাবশালীরা স্টেটের জমি শাহপীর স্কুল মাঠের জন্য দখল করেছে। মাঠের গ্যালারী নির্মাণের সময় আমি আদালতে মামলা দায়ের করি। এছাড়া আমি ওয়াকফ প্রশাসনের নিকট এই তথাকথিত মতোয়াল্লী অপসারণ ও বেদখলীয় সম্পত্তি পুনঃ উদ্ধারের জন্য মামলা দায়েরসহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলে তারা আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি শুরু করে। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হয়েও আমাকে জামায়াতের নেতা সাজিয়ে মিথ্যা রাজনৈতিক ও ধর্ষণ মামলাসহ একাধিক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া দেয়। রাজনৈতিক ও ধর্ষণ মামলাসহ আমি এখন অনেক মামলার আসামি।
শাহজাহান আরো বলেন, আমার ভাড়া ঘর থেকে ভাড়াটিয়া বের করে দিয়ে সেগুলো ভেঙ্গে চুরে দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এই সিন্ডিকেট। তাদের অত্যাচারে আমি দীর্ঘদিন যাবৎ বাড়ি ছাড়া। গত ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার আমি বাড়িতে গেলে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আমাকে অপহরণের চেষ্টা করলে এসময় আমি মোস্তফা বেগম গার্লস স্কুলের কেরানির রুমে ঢুকে গিয়ে ৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করলেও অজানা কারণে থানা মামলা গ্রহণ করেনি। ইদানিং প্রশাসনের সহযোগীতা থেকেও আমি বঞ্চিত। আমার স্ত্রী ও ছোট বাচ্চার উপরও হামলা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমি পরিবার নিয়ে মানবতার জীবন-যাপন করছি। যত হামলা-মামলা হউক ওয়াকফ স্টেটের সম্পত্তি পুনঃ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমি এক কদমও পিছু হাটবো না। স্টেটের সম্পত্তি উদ্ধার করতে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক আন্তরিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সম্পাদক ও মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে ব্যস্ত।
শাহপীর পাইলট হাই স্কুলের সাবেক ইংরেজি শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, ভলিবল জাতীয় দলের সদস্য ও সিজেকেএস এর কাউন্সিলর এস.কে শামসুল ইসলাম এবিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, এই স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়েছে ১৯৯৪ সালে। যদি ওয়াকফ স্টেটের জায়গা এখানে থাকে তাহলে মতোয়াল্লী কিংবা ওয়ারিশরা তখন নীরব ছিলো কেন? ওয়াকফ স্টেটের জায়গা কোথায় সেটা মতোয়াল্লী বা ওয়ারিশরাই জানতে পারবে।
স্কুলের মাঠে অর্থাৎ স্টেডিয়ামে ওয়াকফ স্টেটের জমি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে শাহপীর পাইলট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব আবু বক্কর বলেন, আমি ২০১৫ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। এই স্টেডিয়ামের ভূমিদাতা কারা সেটা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ অবগত নই, তবে যতটুকু জানি স্কুলের মাঠ অর্থাৎ স্টেডিয়ামের সব জমি বৈধ। সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়ও কিছু জমি রেজিস্ট্রি নিয়েছেন। আমার কাছে বিদ্যালয় ভবনের জমির দলিলপত্র থাকলেও স্টেডিয়ামের সমস্ত দলিল উনার কাছে থাকবে, তিনিই এবিষয়ে সব জানবেন।
আহমদুর রহমান ওয়াকফ স্টেটের জমি মসজিদের খেদমতে ব্যবহার করা হয় কিনা জানতে চাইলে দরবেশিয়া শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ মনছুর বলেন, আমি একজন ব্যবসায়ী। এলাকাবাসীর অনুরোধে আমি এই মসজিদের দায়িত্ব পালন করতেছি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই ওয়াকফ স্টেট থেকে মসজিদের জন্য ১ টাকার অনুদানও পাইনি। ওয়াকফ স্টেটের সম্পত্তি ওয়ারিশরা ভোগ দখল ও বয়-বিক্রি করে খাচ্ছেন। তাদের সাথে তো আমরা ঝগড়া করে ওয়াকফ স্টেটের জমি নিতে পারবো না। আমরা খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করতেছি তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় সম্প্রতি ১ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছেন।
এই ব্যাপারে মতোয়াল্লী জান্নাত আরা বেগম বলেন, আমি মহিলা মানুষ দায়িত্ব পালন করতেছি সেটাও অনেক বেশি। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমাদের এক ওয়ারিশ শাহজাহান (সম্পর্কে দেবর) আমার বিরুদ্ধে ওয়াকফ অফিসে অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করতেছে। স্টেটের জমি বেদখল হলেও কিছু করার নেই। স্টেটের কিছু জমি আমার এক নিকটাত্মীয় মনছুর বিক্রি করেছেন, কিছু জমি স্টেডিয়ামের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান দখলে নিয়েছেন। এছাড়া আর বেশি কিছু আমি জানি না। আমার একজন মুরুব্বি অর্থাৎ আইনজীবী উপদেষ্টা আছেন; উনার সাথে আলাপ করা ছাড়া আর কিছু বলতে পারবো না।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জোন-৪ এর ওয়াকফ স্টেটের অডিটর মোঃ সাখাওয়াত হোছাইন বলেন, বর্তমান মতোয়াল্লী জান্নাত আরা বেগম কিভাবে দায়িত্ব পেলেন আমি জানি না। তবে তিনি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন করতেছেন। বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের আইন অনুযায়ী তিনি মতোয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এই ব্যাপারে শাহজাহান নামের একজন ওয়ারিশ মামলা দায়ের করেছেন। দ্রুত তদন্ত করে মতোয়াল্লীকে অপসারণের জন্য প্রশাসকের কাছে সুপারিশ করবো। ওয়াকফ স্টেটের সম্পত্তি বেহাত হওয়ার জন্য মতোয়াল্লীকে দায়ী করে তিনি বলেন, এই সম্পত্তি খুব সহজে বেদখল হলেও সেটা পুনঃ উদ্ধার করতে অনেক কষ্ট হবে। আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
ওয়াকফ স্টেটের কিছু জায়গা শাহপীর পাইলট হাই স্কুলের মাঠের ভেতরে রয়েছে সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ উল্ল্যাহ বলেন, আমি দায়িত্ব পালন করতেছি মাত্র ৬ মাস হলো; তাই এসব বিষয়ে অবগত নয়। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানবেন উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়। এই ব্যাপারে লোহাগাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বাবুলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ভারতে চিকিৎসাধীন থাকায় সম্ভব হয়নি। এই ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসক জনাব খান মো: নুরুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তিনি ছুটিতে থাকায় তা সম্ভব হয়নি।