পানি না পাওয়ার পরও বিল করা, গড় বিল, অতিরিক্ত বিল, এমনকি ‘ভূতুড়ে’ বিল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে। বিল নিয়ে এসব অনিয়মে জড়িত মিটার রিডাররা (এমআই)। রাজস্ব সহকারীদের যোগসাজশে এমআইরা মিটারি রিডিং নিয়ে নয়ছয় করে আসছিলো। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও ওয়াসা যেন এমআইদের হাতে জিম্মি। এখন এই জিম্মি দশা থেকে বের হতে চায় ওয়াসা। এমআইদের লাগাম টেনে গ্রাহকদের সঠিক বিল দেয়ার ক্যাম্পেইনে নেমেছে সংস্থাটি। এমআইদের ‘অত্যাচার’ থেকে রেহাই দিতে কয়েকটি পন্থাও অবলম্বন করছে ওয়াসা।
প্রাথমিকভাবে বিলের যন্ত্রণা থেকে গ্রাহককে মুক্তি দিতে ‘নিজের বিল নিজেই করুন’ ক্যাম্পেইন হাতে নিয়েছে ওয়াসা। নগরীর হালিশহর বি-বøকের গ্রাহকদের জন্য চলতি ডিসেম্বর থেকে এ সেবা শুরু করা হয়েছে। বিলজারী সেবা সহজীকরণের জন্য নেয়া এ উদ্যোগ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। নিজের বিল নিজে করার জন্য গ্রাহককে প্রতিমাসের ৫ তারিখের মধ্যে তাদের সংযোগের হিসাব নম্বরসহ রিডিং বুঝা যায় এমনভাবে মিটারের স্পষ্ট ছবি তুলে তা ০১৭০৯০৯৯২৪,০১৭৩০৯০৯১২৩ নম্বরে ইমু বা হোয়াটস অ্যাপে পাঠাতে হবে। অথবা ইমেইলও করা যাবে। সেই মিটার রিডিং অনুযায়ী বিল তৈরি করে তা গ্রাহকের কাছে পাঠাবে ওয়াসা। পরে গ্রাহক মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করতে পারবেন। এ ব্যবস্থায় গ্রাহকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিল প্রস্তুত করা হবে। গ্রাহক সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কিনা সেটা প্রতি তিনমাস অন্তর অন্তর ওয়াসার পক্ষ থেকে তদারকি করা হবে। তাছাড়া ভ‚তুড়ে বিলের হয়রানি দূর করতে স্মার্ট মিটার চালুর বিষয়টিতেও জোর দিচ্ছে ওয়াসা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, এমআইদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। আমরা চাই গ্রাহককে যেন কোনো ধরনের হয়রানিতে পড়তে না হয়। অনেক গ্রাহকের অভিযোগ বিল পাচ্ছেন না, এমআই বাসায় না গিয়ে ইচ্ছেমতো রিডিং বসিয়ে দিচ্ছে। এসব দূর করার জন্য নিজের বিল নিজে করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। গ্রাহক মিটারের রিডিং-এর ছবি তুলে ইমু বা হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিবে। সে তথ্য অনুযায়ী বিল করে গ্রাহককে পাঠানো হবে। গ্রাহক সঠিক তথ্য দিচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করতে তিনমাস অন্তর অন্তর তদারকি করা হবে। তাছাড়া স্মার্ট মিটার চালুসহ সেবা সহজীকরণের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
মিটার রিডিং না দেখে বিল করার কারণে ভ‚তুড়ে ও গড় বিলের পরিমাণ বাড়ছে ওয়াসায়। এমন ভ‚তুড়ে বিলে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন গ্রাহক। নিয়মিত অভিযোগ নিয়ে হাজির হচ্ছে ওয়াসায়। গ্রাহকের সাথে দিন দিন ওয়াসার সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নিচ্ছে। গ্রাহকদের সেই তিক্ততা থেকে রেহাই দিতে সেবা সহজীকরণের চেষ্টা করছে ওয়াসা। প্রাথমিকভাবে গ্রাহকের নিজের বিল নিজে তৈরি করা এবং পরবর্তিতে স্মার্ট মিটারের মতো সেবা নিশ্চিত করার চিন্তা আছে সংস্থাটির। ইতিমধ্যে নিজের বিল নিজে ক্যাম্পেইন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে ওয়াসা। এরমাধ্যমে অভিযোগ কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এ এস এম নাজের হোসেন বলেন, সেবা সহজীকরণ একটি ইতিবাচক দিক। নিজের বিল নিজে করার মাধ্যমে মিটার রিডারদের দৌরাত্ম্য কমানোর সাথে সাথে সঠিক বিল আদায় করতে পারবে ওয়াসা। আগে মিটার রিডাররা ইচ্ছেমত বিল করতো, আবার আঁতাতের মাধ্যমে বিল করতো। এখন সেটা অনেকাংশে বন্ধ হতে পারে। তবে এখনও মিটার রিডাররা তদারকিতে থাকবে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের তদারকি নিশ্চিত করা না হলে মিটার রিডারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না।
সেবা সহজীকরণের উদ্যোগ হিসাবে শুধু নিজের বিল নিজে করার ক্যাম্পেইনে থেমে থাকেনি ওয়াসা। বিল ব্যবস্থার আধুনিকায়নের চেষ্টাও আছে সংস্থাটির। এছাড়া বিল আদায় প্রক্রিয়াতেও সহজীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে বিল আদায় আরো জোরদারের চেষ্টা চলছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ভ‚তুড়ে ও গড় বিল কমিয়ে আনার সাথে সাথে সিস্টেম লসের পরিমাণও কমাতে চায় ওয়াসা।
প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা এখন চাহিদার উদ্বৃত্ত পানি উৎপাদন করছে। পানি নিয়ে এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। গ্রাহকের বিল যথা সময়ে পৌঁছানো এবং আদায়ের ব্যাপারে আরো সহজীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এনআরডবিøও বা সিস্টেম লসও ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার চেষ্টা আছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা বর্তমানে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর বিপরীতে দৈনিক চাহিদা রয়েছে ৪২ কোটি লিটার। পানির উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি অপচয়ও বেড়েছে। ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত পানি অপচয় হচ্ছে। অপচয়ের খাতায় বিপুল পানি লিখা হলেও এর বড় একটি অংশ কারচুপি হয় বলে অভিযোগ আছে। ওয়াসা বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও কারচুপি বন্ধ করার জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাছাড়া সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে পিডিবি, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি আধুনিক প্রযুক্তির বিলিং সিস্টেমে গেলেও চট্টগ্রাম ওয়াসা এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই পড়ে আছে। এমআইদের সিন্ডিকেটের কব্জায় আটকে থাকায় ম্যানুয়াল পদ্ধতি থেকে বের হতে পারছে না সংস্থাটি।