আফতাব উদ্দিন।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি উদ্যোগের পরেও এখনো ডলার সংকট ও এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা কাটেনি। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা। এ কারণে আসন্ন রমজান মাসে চাহিদা অনুপাতে পণ্যের যোগান ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হতে পারে। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
আগামী মার্চে রমজান মাস শুরু হচ্ছে। সাধারণত রমজানের একমাস আগেই আমদানি করা পণ্য দেশে চলে আসে। আর এলসি খোলা থেকে আমদানিকৃত পণ্য গুদামজাতের পর সরবরাহ পর্যন্ত প্রায় আড়াই সময় লাগে। এই হিসেবে ব্যবসায়ীদের হাতে আর তিনমাসের মতো সময় আছে। এই সময়ে মধ্যে যদি চলমান সংকটের সমাধান না হয় তাহলে আসন্ন রমজানে ভোগাবে ভোক্তাদের।
বাংলাদেশে গত মে মাস থেকেই ডলারের সংকট তীব্র হতে শুরু করে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এ কারণে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে অনেক জরুরি পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডলার সংকটের কথা বলে মাঝারি ও ছোট আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে ব্যাংক। এমনকি ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের নানা নির্দেশনা থাকলেও ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি নিচ্ছে না বলে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা অভিযোগ করেছেন। অথচ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে অর্থবছরের প্রথম দুই-তিন মাস (জুন-আগস্ট) কম প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কিছুটা কমলেও, পরে তা আবার বেড়ে যায়। বিলাসপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি ডলার সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য মতে, আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২টিতে। এমনকি ডলার সংকট বাড়ার পরও গত অক্টোবর স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ১৩টি।
স্ক্র্যাপ জাহাজের মতো ফল আমদানিও জুলাইয়ের পর থেকে বেড়েছে। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর ও নাশপতি আসে। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৫৪ মেট্রিক টনে। আর সেপ্টেম্বরে আমদানি হয় ৩৪ হাজার ১৯০ টন। আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৮ হাজার টন বেড়ে সর্বশেষ অক্টোবর মাসে আমদানি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৮ টন।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি নির্দেশনার পরও খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে ব্যাংক। সময়ক্ষেপণ করে ব্যবসায়ীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে ব্যাংক। ডলার সংকটের কথা বলা হলেও কেউ কেউ ব্যাংক ম্যানেজ করে কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে। অথচ বাংলাদেশ মুক্ত অর্থনীতির দেশ। এখানে ছোট-বড় সবার সমান সুযোগ থাকা দরকার। তা না হলে ব্যবসায়ীদের বৃহৎ একটি অংশ দেউলিয়া হয়ে যাবে।
একই কথা বলেছেন চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ব্যাংক ডলারের সংকটের কথা বলছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের এলসি নেওয়া হচ্ছে না। তবে এই ফাঁকে কেউ কেউ কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে। আমি এই বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে অবহিত করেছি।
এদিকে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ রমজানে বেশি প্রয়োজনীয় ৮ পণ্যের আমদানিতে এলসি মার্জিন বা নগদ জমা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা এবং এসব পণ্য ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে স¤প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এরপর এলসি মার্জিনে ছাড় দেওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাল ও গম।
তবে ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সুযোগ আগে থেকেই পেয়ে আসছে। ফলে এ নির্দেশনায় আমদানির ক্ষেত্রে সংকট কাটবে না।
এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই রোজার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সংস্থানের দাবি জানিয়েছে। তারা ডলার সংস্থানেই এর সমাধান দেখছেন। পণ্য আমদানির জন্য ডলারের সরবরাহ বাড়ানোই জরুরি মনে করছেন।
এছাড়া আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে চাহিদা মেটাতে সাতটি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করার কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে একটি সভায় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এর প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, চলতি ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি ও গম আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এ পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৮১২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২২.১৯ লাখ টন গম, ৯৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৭ লাখ টন ভোজ্যতেল এবং ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
এছাড়া ছোলা আমদানিতে ১৩৪.৪৯ মিলিয়ন ডলার, খেজুর আমদানিতে ৫২.৬৭ মিলিয়ন ডলার এবং মসুর ডাল আমদানিতে ১৪০.৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।