ইমরান নাজির।
শুষ্ক মৌসুমে অগ্নি-দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। অগ্নি-প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে অধিক অগ্নি-দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে শুধুমাত্র অসতর্কতার কারণেই। আগুনে পুড়ছে বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ মূল্যবান মালামাল। কোথাও কোথাও আগুন কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। বারংবার দুর্ঘটনার পরও তা প্রতিরোধে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি-হ্রাসে গরজ বোধ করছে না কেউই। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে মোবাইল কোর্টের অভিযান জোরদারের তাগিদ দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী বছরের ২৬ ডিসেম্বর নগরীতে অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সমন্বিত টিম এ অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান না থাকাসহ বিভিন্ন অপরাধে একটি বেসরকারি হাসপাতালসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নগরীর ব্যস্ততম ও অগ্নিঝুঁকির তালিকায় ওপরের দিকে থাকা জহুর হকার্স মার্কেট, আগ্রাবাদ ও পতেঙ্গা এলাকায় পরিচালিত পৃথক অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম, জামশেদ আলম রানা ও প্রতীক দত্ত। এসময় নন্দনকানন ফায়ার স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী এবং ফায়ার ইন্সপেক্টর শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন। অভিযানে জহুর হকার্স মার্কেটের ফায়ার এ্যাসেম্বলি এরিয়াতে পার্কিং এরিয়া তৈরি করে পুরো মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ করার দায়ে জহুর হকার্স মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতিকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা, আগ্রাবাদ এলাকায় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ফায়ার সেফটি প্ল্যান না থাকায় দুই লাখ টাকা এবং ফায়ার লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকায় টেক সোডাইস কর্পোরেশনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত ওইদিন জহুর হকার্স মার্কেট কমিটিকে পরবর্তী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিটি দোকানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন এবং ফায়ার সার্ভিস ও পিডিবি’র সাথে সমন্বয় করে অবিলম্বে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করারও নির্দেশ দেন। বাস্তবে সেসব নির্দেশনার কোনও কিছুই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাছাড়া অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মোবাইল কোর্টের আর কোনও অভিযানও পরিচালিত হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ পরিচালক মো. আনিসুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, অসাবধানতা ও অসতর্কতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। আমরা বদভ্যাসগত কারণেই অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি করে রাখি। প্রকৃতপক্ষে অগ্নি-দুর্ঘটনা মোকাবেলার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। একটু সচেতন হলেই অনেক অগ্নি-দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। বহুতল ভবন ও কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম রাখা, ফায়ার ডোর ব্যবহার করা, বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিবছর নিয়মিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র পরীক্ষা করিয়ে রাখা এবং ছোট অবস্থাতেই আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে বড় ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
নগরী ও জেলায় অতিসম্প্রতি বড় দুটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা সাধারণ্যে সবচেয়ে বেশি অলোচিত হচ্ছে। এর মধ্যে গত ১২ জানুয়ারি বিকালে নগরীর স্টেশন রোডে রেয়াজউদ্দিন বাজার সংলগ্ন নূপুর সুপার মার্কেটটির সপ্তম তলার জুতার গুদামে আগুন লাগে। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও কয়েক লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নূপুর সুপার মার্কেটের আশেপাশে পরস্পরের দেয়াল ঘেঁষে আরও কয়েকটি মার্কেট রয়েছে। সেখানে তৈরি পোশাক, শাড়ি কাপড়, কসমেটিকস ও জুতাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফায়ার কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। বরাবরের মত বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই জুতার গুদামে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়েছে। একইদিন দিবাগত মধ্যরাতে জেলার রাঙ্গুনিয়ার পারুয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ার সিএনজি অটোরিক্শা চালক খোকন বসাকের বাড়িতে রান্নার চুলা থেকে আগুন লেগে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ওই পরিবারের পাঁচ সদস্য। এর মধ্যে গৃহকর্তা খোকনের দুই ছেলেমেয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৌরভ বসাক (১২) ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া শায়ন্তী বসাক (৫) ঘরেই মারা যায়। হাসপাতালে মারা গেছেন অগ্নিদদ্ধ খোকনের বৃদ্ধ বাবা কাঙাল বসাক (৭০), মা ললিতা বসাক (৬০) ও স্ত্রী লাকী বসাক (৩২)। হৃদয়বিদারক এই অগ্নি-দুর্ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অগ্নি-দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, উপজেলার চেয়ে নগরীর অভ্যন্তরে অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনি দুর্ঘটনার পর তা নিয়ন্ত্রণের কাজেও অনেক বেশি বেগ পেতে হয় ফায়ার কর্মীদের। নগরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। এতে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর তা নির্বাপণে ফায়ার কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। আবার ভবন মালিকদের অনেকেই ফায়ার সনদ নিলেও সনদে থাকা নির্দেশনা অনুসরণে অভ্যস্ত হচ্ছেন না। একইভাবে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয় না। ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকায় কোনও কোনও সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। খরচ কমাতে ভবনে নিম্নমানের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার একবার লাগালে অকেজো না হওয়া পর্যন্ত আর বদলানোর অভ্যাস নেই। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। নগরে নির্বিচারে জলাশয় ভরাটের কারণে পানির উৎস কমে যাওয়ায় অগ্নি নির্বাপণে প্রায়ই পানি সংকটে ভুগতে হয়।
অপরদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বাণিজ্যিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা গুদাম স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা লংঘন করেই নগরীতে শত শত কেমিক্যাল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ও গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর আছাদগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় টিনশেড ও ঘিঞ্জি পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং স্পিরিটের দোকান ও গুদাম। এসব দোকান ও গুদাম মালিকদের অনেকেরই অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। আবার যারা ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন সেখানেও রয়েছে গোলমাল। অন্যের অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদর্শন করেই সংগ্রহ করা হয়েছে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র। কেউবা ছাড়পত্র নেয়ার পর সেটা আর নবায়ন করেননি। নগরীর বৃহত্তম পাইকারি বাণিজ্যকেন্দ্র আছদগঞ্জের সবকটি কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম মালিক অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র সংগ্রহ করলেও তাদের ৭০ শতাংশ গুদামে কোনও অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই। অথচ, অগ্নি-দুর্ঘটনার প্রতিরোধ ও ঝুঁকি হ্রাসে নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করলেই আগুন লাগলেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।