রাঙ্গুনিয়ায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৫ জনের মৃত্যুর পর খোকন বসাকের বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি যেন থামছে না। গতকাল শনিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, খোকন বসাকের মা ও স্ত্রী-সন্তানদের সৎকার করার জন্য রাধামাধব মন্দিরের পাশে পুরোহিতরা নানা আনুষ্ঠানিকতা সারছেন। খোকন বসাকের পরিবর্তে তার বোনের ছেলে উজ্জল শীল অশ্রুসিক্ত হয়ে ক্রিয়া, পুরব, চিতা বড়ানোসহ সৎকারের ধর্মীয় কর্মকান্ড সম্পন্ন করছেন।
গতকাল শুক্রবার বিকাল ৫টায় শ্মশানে তাদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এসময় ব্যাপক সংখ্যক এলাকার মানুষকে ধর্মীয় কার্যাদিতে অংশ নিতে দেখা যায়।
খোকন বসাকের বড় বোন ঝর্না শীল বিলাপ করছিলেন। এসময় তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতি এমন কেন করল ঈশ্বর। আমার ভাইয়ের মতো এত শান্ত স্বভাবের মানুষ এলাকায় আর একটাও নেই। বসাক পরিবারের হাল কে ধরবে সৃষ্টিকর্তা তুমি বলে দাও।’
খোকন বসাকের ছোট বোন রিনি দেব। গত ২ দিনের কান্নায় অনেকটা নির্বাক তিনি। বিলাপ করে তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে আদর করে কে পিসি ডাকবে। সৌরভ ও শয়ন্তী বলতো একদিন দেখবে, আমরা টেলিভিশনের নামকরা শিল্পী হবো। এখন আমাদের চাওয়া, ভিটের বাতি জ্বালানোর জন্য আমাদের ভাইকে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো।’
বেলা যত বাড়ছে খোকন বসাকের পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখার জন্য দলে দলে উৎসুক জনকার ভিড়ও বাড়তে থাকে। স্বজনদের আহাজারিতে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। মৃত্যুপুরি খোকন বসাকের বাড়ির সামনে তার বড় বোন ঝর্না শীল, ছোট বোন রিনি দেব, তার স্বামী বিজয় দেব, বড় বোনের ছেলে উজ্জল শীলসহ আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে। তারা এ মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
পোড়া বাড়িতে সকালের জন্য রান্না করা সবজি ডেসকিতে পড়ে আছে। সিএনজি অটোরিকশাটি অঙ্গার হয়ে বাড়ির সামনে পড়ে আছে।
খোকন বসাকের ছোট বোনের স্বামী বিজয় দেব জানান, ‘পুড়ে যাওয়া বাড়ির পাশে লাগোয়া রাধা মাধব মন্দিরে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কি তা সিসি ক্যামরার ফুটেজ দেখলে বুঝা যাবে। আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না চুলার আগুন থেকে এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত। দীর্ঘক্ষণ চুলায় আগুন থাকলে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা খোকন বসাক জানতো। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মন্দিরে কীর্তন হয়েছে। মন্দির থেকে বাড়িতে এসে সবাই একসাথে রাতের আহার খেয়েছেন। আমার শাশুড়ির পাতলা পায়খানা হয় কয়েকবার। খোকন বসাক তাকে ওষুধ খাওয়ায়। এরপর প্রতিদিনের মত খোকন বাড়ির সব ঠিক আছে কিনা দেখে তারপর ঘুমাতে যায়। চমেক হাসপাতালে খোকন বসাক আমাকে বলেন, প্রথমে ঘুমের মধ্যে মনে হয়ে বিমান যাওয়ার মতো বিকট শব্দ। এরপর পাশের রুম থেকে ছেলে সৌরভ চিৎকার করে বলে বাবা আগুন, ঘুম থেকে ওঠ। এরপর সবাই একত্রিত হয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। কালো ধুয়ায় পুরো ঘরে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। স্ত্রী লাকী বের না হওয়ার জন্য তার হাত ধরে রাখে। তবুও তিনি সাহস করে সবাইকে তার পেছন পেছন দৌড় দিতে বলে বের হয়ে পড়েন।’
বিজয় দেব বলেন, ‘খোকন বসাক বের হয়ে মন্দিরের পুরোহিত ও আশপাশের মানুষকে আগুন নিভানোর জন্য এগিয়ে আসার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। এরপরেই ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস চলে আসে। ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। খোকন বসাকের স্ত্রী তার ছেলে ও মেয়েকে বাঁচানোর জন্য বুকে আগলে রাখে। বুকে আগলে রাখা দগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।’
বিজয় দেব বলেন, ‘খোকন বসাক হাসপাতালে তাকে বলেন, যাদের ডাকে ঘুম ভাঙল সেই ছেলেমেয়েকেও বাঁচাতে পারলাম না। সবকিছু হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। যাদের জন্য ঘর বানিয়েছি তারা আজ নেই। এ ঘর দিয়ে আমি কি করব।’
জানা যায়, প্রায় ৩০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে খোকন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। আপনজন হারানোর কষ্ট এবং দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা যেন ঘিরে ধরেছে তাকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় খোকনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিজয় দেব জানান, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৬ নম্বর বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা চলছে। মাথা, মুখ, হাত ও পিঠে দগ্ধ হওয়া খোকন বসাক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বেড না থাকায় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তাকে। দুই চোখ দিয়ে পানি ধরে রাখতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পর পর পরিবারের সবাইকে খুঁজে। আবার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানান।’
পারুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এখতেয়ার হোসেন বলেন, ‘খোকনের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে তাকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিজে বিষয়টি তদারকি করছেন। খোকন সুস্থ হলে তার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’