এক ট্রাক, দুই ট্রাক নয়, এক দুইশ’ ট্রাকও নয়, সাত হাজার ট্রাকেরও বেশি সার গায়েব করে দেয়া হয়েছে। সরকারের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার হিসেবে পরিবহনের আড়ালে এই বিপুল পরিমাণ সার গায়েব করে দেয়া হলেও টনক নড়ে একেবারে সব খুঁইয়ে। ৫শ’ কোটিরও বেশি টাকা দামের এত বিপুল পরিমাণ সার কি করে গায়েব করে দেয়া হলো তা নিয়ে তদন্ত অনুসন্ধান সবই চলছে। কিন্তু সরকারের এই বিপুল পরিমাণ সারের হদিস মিলছে না। জাহাজ থেকে ঠিকঠাকভাবে খালাস হলেও সরকারি বাফার গুদামে এসব সার পৌঁছেনি। এক বছরের পরিবহন চুক্তির আটটি চালানে এই বিপুল পরিমাণ সার গায়েব করা হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আমদানি করা ৭২ হাজার ৬৮০ টন ইউরিয়া সার গায়েব করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নরসিংদী–২ আসনের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের (বিএফএ) সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান পোটন। পরিবহনের আড়ালে সরকারি সারের একাধিক চালান খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে ৫শ’ কোটিরও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে বিসিআইসি। বিসিআইসি গত বেশ কিছুদিন ধরে ওই পরিবহন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণসহ সার উদ্ধারের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের কৃষি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সার ইউরিয়া। এই সার দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চড়া দামে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত সার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের সরবরাহ দেয়া হয়। দেশের ইউরিয়া সারের পুরোটাই সরকার নিয়ন্ত্রিত। দেশে প্রায় ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টন বিভিন্ন ধরণের সারের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ
টন। দেশীয় বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৫টি সরকারি গুদামে (বাফার) পরিবহন করা হয়। বিসিআইসির নিয়োজিত ১৫টি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব সার পরিবহন করে বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়।
সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার বন্দর থেকে সরাসরি গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার খোলা অবস্থায় আমদানিকৃত সার সংশ্লিষ্ট কোনো সার কারখানায় নিয়ে গিয়ে বস্তাভর্তি করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই সার পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। বিসিআইসির সাথে ঠিকাদারদের সম্পাদিত পরিবহন চুক্তির ৪(বি) ধারা অনুযায়ী ডেলিভারি চালান ইস্যুর পর ৫০ দিনের মধ্যে বাল্ক ইউরিয়া ও ৪০ দিনের মধ্যে বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার নির্দিষ্ট গুদামে বা ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পোটন ট্রেডার্স বিসিআইসির বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং আমদানি করা সার পরিবহনের আড়ালে ৭২ হাজার টনেরও বেশি সার গায়েব করে দিয়েছে।
এক বছরের সার পরিবহনের আড়ালে এই সার গায়েবের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করে বিসিআইসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, পোটন ট্রেডার্স ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে গত ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৮টি চালান থেকে উপরোক্ত সার গায়েব করে দেয়। ওই সময়ের মধ্যে পোটন ট্রেডার্স সর্বমোট ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯০০ টন সার পরিবহনের দায়িত্ব পায়। এরমধ্যে ৭২ হাজার ৬৮০ টন সার জাহাজ বা কারখানা থেকে গ্রহণ করলেও গুদামে পৌঁছানো হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে চালান গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গুদামে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সুকৌশলে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ সার গায়েব করে দেয়া হয়েছে। এক চালানের সার অপর চালানের দেখিয়ে বাফার গুদামে বুঝিয়ে দেয়া হলেও দিনশেষে গিয়ে সরকারের পাঁচশ’ কোটিরও বেশি টাকা দামের সার খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে বিসিআইসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, পোটন ট্রেডার্স ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর জাহাজ থেকে ৩১ হাজার ৭৪১ টন সার গ্রহণ করে। কিন্তু গুদামে বুঝিয়ে দেয়া হয় ২৭ হাজার ৬৩৩ টন। এই জাহাজের ৪ হাজার ১০৮ টন সারের হদিস নেই। একই বছরের ২৭ নভেম্বর অপর একটি জাহাজ থেকে ৩৩ হাজার টন ইউরিয়া গ্রহণ করলেও গুদামে পৌঁছায় ২২ হাজার ১৫২ টন। গায়েব করে দেয়া হয় ১০ হাজার ৮৪৮ টন। গত বছরের ১০ জানুয়ারি ২৮ হাজার ৮৯১ টন সার জাহাজ থেকে গ্রহণ করলেও গুদামে দিয়েছে ১৯ হাজার ৯১ টন। ৯ হাজার ৮০০ টন সার পথিমধ্যে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে বিসিআইসির ওই কর্মকর্তা জানান, এভাবে দফায় দফায় প্রতিটি চালানেই হাজার হাজার টন সার গায়েব করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পোটন ট্রেডার্স ৭২ হাজার ৬৮০ টন সার গায়েব করেছে। এক ট্রাকে দশ টন করে সার পরিবহন করলেও এই বিপুল পরিমাণ সার কারখানা বা জাহাজ থেকে পরিবহন করতে অন্তত ৭ হাজার বেশি ট্রাক ব্যবহৃত হয়েছে। এত ট্রাকের সার গায়েব করে দেয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নেই বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিআইসির এ কর্মকর্তা জানান, পোটন ট্রেডার্সের মালিক আশরাফ খান পোটনকে দফায় দফায় তাগাদা দেয়া হলেও তিনি সরকারের সারগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।
পোটন ট্রেডার্সের পক্ষ থেকে বিসিআইসিকে বলা হয়েছিল যে, গুদামে জায়গা না থাকায় তারা সার সরবরাহ দিতে পারেনি। কিন্তু বিসিআইসির পক্ষ থেকে দেশের ২৫টি বাফার গুদামের প্রত্যেকটিতেই সার রাখার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে বলা হলেও পোটন ট্রেডার্স এক বস্তা সারও জমা দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে পোটন ট্রেডার্সের মালিক আশরাফ খান পোটনের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগের জন্য দফায় দফায় ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
গতকাল বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, পোটন ট্রেডার্সের কাছ থেকে সারগুলো উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। তবে তার কাছে কোনো সার আছে বলে আমাদের মনে হয় না। তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান বিসিআইসির চেয়ারম্যান।