নজিবুল্লাহ হিরু
উচ্চ আদালতের নির্দেশে সামরিক সরকারের আমলে করা আইন ‘যাকাত ফান্ড অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ বিলুপ্ত করে নতুন আইন করতে ‘চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদ বিল, ২০২২’ নামে উত্থাপিত ‘বিল’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সংসদে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে।
সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিলটি পাসের সুপারিশ করে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাফেজ রুহুল আমীন মাদানী। সরকারিভাবে যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের বিধান রেখে এ আইন করা হচ্ছে।
এর আগে গত ৬ নভেম্বর ‘চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদ বিল, ২০২২’ সংসদে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সামরিক সরকারের আমলে করা আইন ‘যাকাত ফান্ড অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ বিলুপ্ত করে নতুন আইন করতে এই বিল আনা হয়। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বিলটি উত্থাপন করেন। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
বিলে ধর্মমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে যাকাত বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর সদস্য হবেন ধর্ম সচিব (ভাইস চেয়ারম্যান), ধর্ম, অর্থ ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন করে যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার তিন কর্মকর্তা, সরকার মনোনীত পাঁচ জন আলেম, সরকার মনোনীত ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের দুইজন প্রতিনিধি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (সদস্য সচিব)। বছরে এই বোর্ডের কমপক্ষে দুইটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সরকার এ বোর্ডের পরিচালনা ব্যয় বহন করবে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, যাকাত সংগ্রহ, বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির ক্ষমতা বোর্ডের থাকবে। কমিটি গঠন সম্পর্কে বিলে বলা হয়েছে, স্থানীয়ভাবে যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে কেন্দ্রীয়, সিটি কর্পোরেশন, বিভাগ, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিটি গঠন করতে পারবে।
যাকাত তহবিল গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে সংগৃহীত যাকাত; প্রবাসী বাংলাদেশি মুসলিম নাগরিক, কোনো বিদেশি মুসলিম ব্যক্তি বা কোনো সংস্থায় জমাকৃত যাকাতের অর্থ থেকে পাওয়া যাকাত এবং শরিয়াহ সম্মত অন্য কোন উৎস্য থেকে পাওয়া যাকাত। শরিয়াহ সম্মত খাত ব্যতীত অন্য কোন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় বা বিতরণ করা যাবে না।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কিত বিবৃতিতে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সামর্থবান মুসলিমের ওপর আল্লাহ যাকাত ফরজ করেছেন। যাকাত দারিদ্র বিমোচন ও পুনর্বাসনের হাতিয়ার। যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয়, বরং যাকাত ধনীর সম্পদ থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্য আল্লাহ নির্ধারিত বাধ্যতামূলকভাবে দেওয়া নির্দিষ্ট অংশ। দেশে ব্যক্তিগগত পর্যায়ে যাকাত ব্যবস্থা চালু থাকলেও নানা কারণে তার কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। যাকাতের মাধ্যমে এক সময় সারা মুসলিম জাহানে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব হয়েছিল। এই আইন পাস হলে দেশ থেকে দারিদ্র দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামে অবস্থিত মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার সাথে মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী সম্পর্কিত। এই কিল্লা বা কেল্লায় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁ’র ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভিতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিল্লা’। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে এখানে নির্মাণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।’
১৬৬৭ সালে এই মসজিদ নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠে আন্দরকিল্লার এই মসজিদ। এই মসজিদের ইমাম/খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসুলগণ। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই মসজিদ জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোঘল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভুমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ, ৭.৫ গজ (৬.৯ মিটার) প্রস্থ এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজগুলির মধ্যে এর পেছনদিকের দুটি এখন বিদ্যমান। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
মসজিদটি নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার জন্ম দেয়। শুধু স্থাপত্য নিদর্শনই নয়, শৈল্পিক দিক থেকেও এই মসজিদ উল্লেখযোগ্য। কারণ চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ হিসেবে শিলালিপি ভিত্তিক যেসব স্থাপনা আছে, সেগুলোর মধ্যে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের গায়ের শিলালিপি অন্যতম। এই মসজিদে পাওয়া সকল শিলালিপির সাথে সিরিয়ার ‘রাক্কা নগর’-এর স্থাপত্যকলার মিল রয়েছে।