নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের সার্ভার আইডি হ্যাক করে সনদ জালিয়াতি করে আসা একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্যের কথা জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। গত সাত মাসে চক্রটি প্রায় পাঁচ হাজার জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছে। সিএমপি কমিশনার বলেন, জালিয়াত চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নাগরিক, রোহিঙ্গা শরণার্থী কিংবা সরকারি অফিসের ভেতরের কেউ জড়িত আছে কিনা যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এসব চক্রের অনেকেই আমাদের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ওয়ার্ড কার্যালয়ে অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধনের তথ্য মেলার পর পুলিশ ‘সাইবার পেট্রোলিংয়ের’ মাধ্যমে নজরদারি শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিটের উপ–পুলিশ কমিশনার ডা. মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, কাউন্সিলর অফিসের সার্ভার ব্যবহার করে গত ৮ থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের ৩৮, ১১, ১৩, ৩২ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে অবৈধভাবে অতিরিক্ত জন্মনিবন্ধনের ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে ৮ জানুয়ারি ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০টি, ৯ জানুয়ারি ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১০টি, ২১ জানুয়ারি ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৪টি ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের খবর পাই। শুধু তাই নয়, ১০, ১৮ ও ২২ জানুয়ারি তিন দিনে ১১ নম্বর ওয়ার্ডেই অবৈধভাবে ৪০৯টি জন্মনিবন্ধন করা হয়। এসব ঘটনায় নগরীর বিভিন্ন থানায় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের পক্ষে জিডি করা হয়; আর ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন বাদি হয়ে খুলশী থানায় সোমবার একটি মামলা করেন। এরপর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ছায়া অনুসন্ধানে নামেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। অনুসন্ধানে আমরা একাধিক জালিয়াত চক্রের খবর পাই। এর মধ্যে গত সোমবার একটি চক্রের চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. মোস্তাকিম (২২), দোলোয়ার হোসাইন সাইমন (২৩) ও আব্দুর রহমান ওরফে আরিফ এবং জহির আলম (১৬)।
জহির ছাড়া বাকি তিনজন গতকাল মঙ্গলবার পৃথকভাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমান, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেন এবং অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিমের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
উপ–পুলিশ কমিশনার ডা. মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ আরও বলেন, কোনো ব্যক্তি ফেসবুক ব্যবহারের সময় বার্থ সার্টিফিকেটের বিভিন্ন পেজ দেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনের জন্য যোগাযোগ করে থাকে। এরপর জালিয়াত চক্রের সদস্যরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সরকারের নির্ধারিত সাইটে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধনের কাজ শেষ করে। পরে একজন হ্যাকার অবৈধভাবে সার্ভারে ঢুকে জাল সনদ তৈরি করে। এই চক্রটির কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তারা ৫ হাজারের বেশি জন্ম নিবন্ধন তৈরি ও বিতরণ করেছে। সারাদেশে একাধিক জালিয়াতি চক্র অবৈধভাবে এ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। একেকটি চক্রে ৩০ থেকে ১০০ জন সদস্য রয়েছে।
তিনি জানান, যাদের ধরা হয়েছে, তারা ‘মাঠ পর্যায়ের’ তথ্য সংগ্রহকারী। মূলত যাদের জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন, সে ধরনের লোকজন খুঁজে বের করে তারা তথ্য সংগ্রহ করেন। তাদের উপরে আরেকটি গ্রুপ আছে। তারা বিভিন্ন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করে তাদের চক্রের অন্যদের কাছে পাঠান। সেখান থেকেই তারা সার্ভারে ইনপুট করে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এ চক্রের সদস্যরা তিনটি মাধ্যমে লোকজন সংগ্রহ করতো জন্ম নিবন্ধনের জন্য। একটি মাধ্যম হলো ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ করে, আরেকটি মাধ্যম সরাসরি লোকজনের সঙ্গে কথা বলে; এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের আশপাশে থাকা কম্পিউটার দোকানগুলোর মাধ্যমে লোকজন সংগ্রহ করত তারা।
অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন জানান, গ্রেপ্তার চারজন একই চক্রের সদস্য। ১৬ বছর বয়সী কিশোরটি জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে চক্রটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পরে সে তার দুলাভাই মোস্তাকিমকেও এতে যুক্ত করে। আর গ্রেপ্তার সাইমন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আরিফ একটি দোকান পরিচালনা করেন। তিনি আরও জানান, চক্রটি হোয়াটসঅ্যাপে ‘বিজনেস গ্রুপ’ পরিচালনা করে যোগাযোগ করে থাকে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে জব্দ করা কম্পিউটার ও মোবাইলে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাদের ‘উপরে’ যে ব্যক্তি আছে, তাদের তারা চেনেন না বলে দাবি করেছেন, যিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘হ্যাকার’ হিসেবে।