এজাহারে তিনি লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ‘সেনাবাহিনীর বিপথগামী, বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে’ নিহত হন তার বাবা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, যিনি তখন সেনাবাহিনীর ৭২ ব্রিগেডের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমকেও একই সময়ে হত্যা করা হয়। নাহিদ ইজাহার খান তার মামলায় বলেছেন, সেই সময়ের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের নির্দেশে ২০–২৫ জন সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকের একটি দল নাজমুল হুদাসহ তিন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে কেবল ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক মেজর আব্দুল জলিল জীবিত আছেন জানিয়ে তাকেই মামলার এজাহারে আসামি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার আজিমুল হক বলেন, ‘বুধবার রাতে শেরে বাংলা নগর থানায় মামলাটি হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।’
কী ঘটেছিল সে সময় : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় বসলেও চলছিল অস্থিরতা। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের পর সেনা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়, গৃহবন্দী করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান হয় সেনা বাহিনী ছেড়ে আসা আবু তাহেরের নেতৃত্বে। তখন মুক্ত হন জিয়া; নিহত হন খালেদ মোশাররফসহ তার সঙ্গীরা। জিয়ার গড়া দল বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ওই দিনটি ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে; তাহেরের দল জাসদ পালন করে ‘সিপাহী–জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে; ‘মুক্তিযোদ্ধা ও সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আওয়ামী বলয়ের সংগঠনগুলো। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়া, যিনি মুক্তিযুদ্ধে একটি সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। পরে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপ্রধানও হন।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮২ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সেনা বিদ্রোহে নিহত হন। পরে উচ্চ আদালতের এক রায়ে জিয়ার সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়। আর কয়েকটি রিট মামলার রায়ে হাই কোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়, কর্নেল আবু তাহেরের গোপন বিচার ছিল অবৈধ। তাহের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার; আর এর পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে খালেদ মোশাররফ, এ টি এম হায়দার এবং নাজমুল হুদার হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা নিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের আক্ষেপ ছিল। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, দেরিতে হলেও এ বিচার সম্ভব। কারণ, তার ভাষায়, ‘মার্ডার কেস কোনোদিন তামাদি হয় না।’ এখন নাজমুল হুদার মেয়ের মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে এত বছর পর সেই বিচার শুরুর পথ তৈরি হল।
যা আছে এজাহারে : নাহিদ ইজাহার মামলায় বলেছেন, ১৯৭৫ সালে তার বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তার বয়স মোটে ৫ বছর, তার বড় ভাইয়ের বয়স ৮ বছর।
‘তখন আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭২ বিশেষ কমান্ডার, রংপুর, কর্মরত অবস্থায় ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপথগামী, বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে নিহত (শহীদ) হন। তার সাথে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর–উত্তম এবং শহীদ লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার, বীর–উত্তমও নিহত (শহীদ) হন।’
মামলায় বলা হয়, ‘পরবর্তীতে আমরা বড় হয়ে বাবার কোর্সমেট, কলিগ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে নিজেদের অনুসন্ধানে জানতে পারি, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালবেলা বাবাসহ অপর দুই সামরিক কর্মকর্তা ১০ নম্বর ইস্ট বেঙ্গলের অফিসে উপস্থিত ছিলেন, যেটি তখন জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেল ছিল। ভোরবেলা বাবারা নাশতা করা অবস্থায় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে একটি টেলিফোন আসে দশম ইস্ট বেঙ্গলের সিও লে. কর্নেল নওয়াজেশের কাছে। এরপর বাবাসহ অপর দুই সামরিক কর্মকর্তাকে বাইরে নিয়ে আসেন দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তারা।’
‘আমাদের অনুসন্ধানে আমরা আরও জানতে পারি, তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদের নেতা লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের নির্দেশে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা মৃত মেজর মো. আসাদুজ্জামান (অব.) এবং মেজর মো. আব্দুল জলিল (অব.), দশম ইস্ট বেঙ্গলের অপরাপর কর্মকর্তারা, জেসিও ও সৈনিকরা মিলে আনুমানিক ২০–২৫ জন অজ্ঞাতনামা সংঘবদ্ধভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলের মাঠে ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টার মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে আমার বাবাসহ উল্লেখিত অপর দুই সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে গুলি করার পর বেয়নেট চার্জ করা হয়। উক্ত হত্যাকাণ্ডের সময় ১০ ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা লে. কর্নেল সিরাজ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ও মেজর মুকতাদির, সাবেক পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ঘটনাস্থলে চাক্ষুস সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মামলায় আসাদুজ্জামান ও আব্দুল জলিলের বাসার ঠিকানা, সেনাবাহিনীর নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে।’
মামলায় বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধে বাবা যোগদান করেন এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন যশোর ৮ নং সেক্টরের বয়রা সাব–সেক্টর কমান্ডার। তাঁর সরাসরি নেতৃত্বে পরিচালিত বিখ্যাত গরিবপুরের ট্যাংক যুদ্ধ, চৌগাছা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল এবং ৬ ডিসেম্বর বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম জেলা হিসাবে যশোর মুক্ত হয়। আমাদের জন্য সময়টা এতটাই প্রতিকূল ছিল যে, একবার ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার কাছে আমার ভাই গিয়েছিল বাবার নামে রাস্তার নামকরণের জন্য। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাস্তার নামকরণ করা হচ্ছিল। তিনি ভাইয়ের আবেদনপত্র হাতে নিয়ে আমার বাবার নাম দেখে ভাইকে তার অফিস কক্ষ থেকে বের করে দেন।
নাহিদ ইজাহার মামলায় বলেছেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতায় আছে। সকল দেশবাসী ন্যায়বিচার পাচ্ছে। তাই আমি আমার বাবাসহ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক কর্মকর্তা হত্যার বিচার দাবি করছি। এমতাবস্থায়, এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিয়মিত মামলা রুজু করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।