দেশের ইতিহাসে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা সবচেয়ে বড় জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২২৯ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজটিকে গভীর সাগরে রেখে ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে নিয়ে আসা হবে। এর মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তেল খালাসে সর্বাধুনিক যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ।
মহেশখালীর অদূরে বঙ্গোপসাগরের গভীরে স্থাপিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম থেকে সৌদি আরব থেকে আমদানিকৃত ৮২ হাজার টনের বেশি ক্রুড অয়েল খালাসের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম গতকাল শুরু হয়। এই কার্যক্রম তদারকি করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। আগে এই ধরনের একটি অয়েল ট্যাংকার থেকে জ্বালানি তেল লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত আনতে ১১/১২ দিন সময় লাগত। এখন মাত্র ৩০ ঘণ্টায় এই তেল খালাস করে ফিরতি পথ ধরবে এমটি হোরে নামের পানামার পতাকাবাহী জাহাজটি। এতে দেশের কয়েক লাখ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটির মাধ্যমে বছরে তাদের অন্তত ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পরিশোধিত (রিফাইন্ড) এবং অপরিশোধিত (ক্রুড অয়েল) মিলে বছরে ৬০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর পুরোটা আনা হয় সাগরপথে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা জ্বালানি তেলবাহী বড় বড় অয়েল ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নিত। ওখান থেকে লাইটার ট্যাংকারে করে তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিপিসির কোটি কোটি টাকা খরচ হতো এবং দীর্ঘ সময় লাগত। লাইটারেজ করার সময় নানা কারণে অপচয়সহ বিপুল পরিমাণ তেল চুরি হতো। জ্বালানি তেল খালাসের মান্দাতার আমলের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বিপিসির হিসেব মতে, মাদার ভ্যাসেল বসিয়ে রাখা এবং বিএসসির দুটি জাহাজ দিয়ে তেল লাইটারিং করতে বিপিসির বছরে খরচ হতো প্রায় ৮শ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতিতে দ্রুত জ্বালানি তেল খালাস, খালাসে সময় হ্রাস ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন নির্মাণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০১৫ সালে। ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতা এবং প্রতিকূলতায় তা হয়নি। পরে প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বৃদ্ধি করা হয়। একই সাথে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়ও। বর্তমানে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিটুজি চুক্তির আওতায় ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন সরকার। বিপিসি দিয়েছে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ৬০১ কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
প্রকল্পের আওতায় এক সেট এসপিএম–পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, দুই লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক, তিনটি ব্লক ভাল্ব স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল এই প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাইপলাইনে তেলের প্রবাহ শুরু করার আগের কিছু কার্যক্রম শেষ করার পর এই জাহাজের তেল খালাস সম্পন্ন হতে ৩০ ঘণ্টা সময় লাগবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাস সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সৌদি আরব থেকে ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা এমটি হোরে জাহাজকে গতকাল সকাল থেকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে বার্থিং করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যডমিরাল এম সোহায়েলের নেতৃত্বে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরেজমিনে উপস্থিত থেকে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজটিকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বার্থিং করানো হয়। এ সময় বন্দরের শক্তিশালী কয়েকটি টাগ জাহাজটিকে বার্থিংয়ে সহায়তা করে।
গতকাল বিকেল ৪টার দিকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে রশি দিয়ে তেলবাহী এমটি শোরে জাহাজটি আটকানো হয়। পরে মুরিং পয়েন্ট থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের সাথে জাহাজটির পাইপের সংযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় বন্দরের টাগের পাশাপাশি একটি বিশেষায়িত বেসরকারি টাগও কাজে যোগ দেয়। কিছু কার্যক্রম শেষ করার পর জাহাজটির ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল পাইপলাইনে সরবরাহ শুরু হয়। ৩০ ঘণ্টায় তেল খালাস সম্পন্ন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। প্রথম জাহাজ হিসেবে নতুন পাইপলাইনে তেল প্রবাহ শুরুর আগে কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে। আজ সোমবার সকাল থেকে এই তেল সরবরাহ শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করার বিষয়টি তদারক করার সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, অনেক উন্নত দেশকে টেক্কা দিয়ে গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। সৌদি আরব থেকে আনা ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েলের পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হয়েছে গভীর বঙ্গোপসাগরে। তিনি জানান, ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে এই তেল আসবে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কারণে তেল খালাসের সিস্টেম লস ও খরচ কমার পাশাপাশি সময় ১২/১৩ দিন কমে মাত্র ২ দিনে নেমে আসবে। পুরো প্রক্রিয়াটিকে অত্যাধুনিক এবং স্মার্ট একটি সিস্টেম বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আজকের দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটি দিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই প্রকল্প সেই যাত্রাকে অনেক দূর এগিয়ে দিল। তিনি বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি তেল পরিবহন এবং ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি ঘটবে। পরিবেশ, প্রতিবেশসহ নানা খাতে সুফল মিলবে। এই উদ্যোগের ফলে দেশের শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
উল্লেখ্য, আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।