‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানি, লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী’। পাহাড় থেকে নেমে এ নদী কোথায় গেছে এটা মীমাংসিত হলেও এখনো সীমানাহারা কর্ণফুলীর সমগ্র গতিপথ। বহু বছরেও নদী তীরের দিয়ারা (জেগে ওঠা নতুন ভুখন্ড) জরিপ, সীমানা নির্ধারণ ও সীমানা পিলার স্থাপন হয়নি। চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলার ১০টি উপজেলাকে কর্ণফুলী ছুঁয়ে গেলেও ভূমি অফিসগুলোতে সংরক্ষিত নেই সিএস ও আরএস মৌজা ম্যাপ। ৭৭টি মৌজার মধ্যে ৩৯টি মৌজার বিএস ম্যাপ ভূমি অফিসে থাকলেও ৩৮টি মৌজার কোনো ম্যাপ পাওয়া যায়নি। গত নভেম্বর মাসে দেয়া নদী সমীক্ষা প্রতিবেদনে কর্ণফুলী নদী নিয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। নদী দূষণ, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং অন্যান্য দূষণ থেকে ৪৮টি নদী রক্ষা ও নদীর তথ্য ভান্ডার তৈরি প্রকল্পের অধীনে এ সমীক্ষা চালিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদী রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার বড় হরিনা মৌজা থেকে শুরু করে রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই উপজেলা ও চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, পটিয়া, কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দক্ষিণ পতেঙ্গা (ডান পাশ) ও আনোয়ারা উপজেলার মাঝের চর মৌজার (বাম পাশ) মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলার ১০টি উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়নের ৭৭টি মৌজা ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
রাঙামাটির বরকল উপজেলার বড় হরিনায় পাঁচটি, ভূষণছড়ায় একটি, আইমাছড়ায় দুটি, বরকলে চারটি, শুভলংয়ে চারটি, রাঙামাটি সদরের বালুখালীতে তিনটি, বন্দুক ভাঙ্গায় একটি, মগবানে তিনটি, জীবতলীতে তিনটি, কাপ্তাই উপজেলার কাপ্তাইয়ে একটি, চিৎমোরমে একটি, ওয়াজ্ঞায় একটি ও রায়খালীতে দুটি মৌজা আছে।
এসব মৌজার কোনোটিরই জরিপ হয়নি এবং কোনোধরনের মৌজা ম্যাপ নাই। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনায় একটি, পৌরসভায় দুটি, বেতাগীতে চারটি, কোদালায় দুটি, শিলকে একটি, সরফভাটায় একটি, বোয়ালখালীর খরনদ্বীপে পাঁচটি, চরনদ্বীপে একটি, কধুরখীলে একটি, পশ্চিম গোমদন্ডীতে চারটি, রাউজানের বাগোয়ানে একটি, নোয়াপাড়ায় একটি, পটিয়ার কোলগাঁওয়ে একটি, কর্ণফুলীর শিকলবাহায় দুটি, চর পাথরঘাটায় দুটি, জুলদায় দুটি ও বড় উঠানে একটি মৌজা আছে। এসব মৌজার সিএস ও আরএস ম্যাপ না থাকলেও বিএস ম্যাপ আছে। আনোয়ারার বৈরাগে তিনটি মৌজার কোনোটিরই বিএস ম্যাপ নাই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের চান্দগাঁও সার্কেলে তিনটি, সদর সার্কেলে একটি, বাকলিয়ায় সার্কেল দুটি, আগ্রাবাদে দুটি, সিটি কর্পোরেশনে দুটি, পতেঙ্গা সার্কেলে দুটি মৌজা আছে। সাতটির বিএস মৌজা ম্যাপ আছে, বাকিগুলোর নাই।
চার সমস্যা, তিন সুপারিশ : কর্ণফুলী নদীর গতিপথ ও মৌজা চিহ্নিত করতে গিয়ে নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা টিম নদীর দিয়ারা জরিপ না হওয়া, মৌজা ম্যাপ, সীমানা নির্ধারণ ও সীমানা পিলার না থাকার মতো চারটি সমস্যা চিহ্নিত করেন। এসব সমস্যা সমাধানে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হলো, জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে নদীর জমির সিএস মৌজাসহ সকল জরিপের ম্যাপ আবশ্যিকভাবে সংগ্রহে রাখতে হবে। যেসব মৌজায় নদী ভাঙ্গন হয়েছে সে সমস্ত মৌজায় দিয়ারা জরিপ সম্পন্ন করে নদীর রেকর্ড হালনাগাদ সম্পন্ন করতে হবে। নদীর জমি ভুলক্রমে ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভুক্ত হলে জমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ১৪৯ (৪) ধারায় রেকর্ড সংশোধনপূর্বক নদীর জমির মালিকানা হালনাগাদ করবে। জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহব্বায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির আহব্বায়ক হিসেবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন বলে নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রতিবেদন জমার গত আট মাসেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের আওতাভুক্ত জায়গায় কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বন্দরের যে জায়গা আছে সেগুলো তারা উচ্ছেদ করবে।’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক তথ্যে বলা হয়েছে, পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা বা জোয়ার ভাটার প্রভাব ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট পর্যন্ত উঠানামা করে। এই নদী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত তৃতীয় শ্রেণীর নৌপথ। এই নদীর বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সর্বনিম্ন ১৬১ মিটার, সর্বোচ্চ ৯৬০ মিটার এবং গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার। কর্ণফুলীর তিনটি উপ নদী হলো ইছামতি, হালদা ও কাসালং।