অক্টোবর ৫, ২০২৪ ৬:১৫ অপরাহ্ণ

৭৮টি স্পটে কর্ণফুলী দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত

  1. সেলিম মালেক।

চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির ৭৯টি স্পটে প্রতিনিয়ত বর্জ্য পড়ে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। হাট-বাজারের বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য, সংযোগ খালের বর্জ্য, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাইপ, পোল্ট্রি ও গরুর ফার্মের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের তরল ও কঠিন বর্জ্যগুলো এসব উৎসমুখ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। চিহ্নিত দূষণের কারণে পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যে ভরাট হচ্ছে নদীর তলদেশ। এতে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। কয়েকটি নামিদামি প্রতিষ্ঠানও কর্ণফুলী নদী দূষণের সাথে জড়িত। যেসব স্থান দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে বর্জ্য পড়ছে সেসব স্থানে অস্বাভাবিক পানির রঙ ধারণ করেছে।
কর্ণফুলী নদী নিয়ে দেয়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। কর্ণফুলী নদীর এমন দূষণ বন্ধে ইটিপি চালু রাখা, পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন, পরিশোধন, জৈব সার উৎপাদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। পাঁচটি দপ্তরকে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

 

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতটি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ২৯টি মৌজায় ৭৯টি স্পটে প্রতিনিয়ত কর্ণফুলী দূষিত হচ্ছে। সাতটি চিহ্নিত কারণে দূষণ বেশি হচ্ছে। হাট-বাজারের বর্জ্যে ১০টি, শিল্প কারখানার বর্জ্যে পাঁচটি, সংযোগ খালের বর্জ্যে ২১টি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাইপ দিয়ে পড়া বর্জ্যে সাতটি, পোল্ট্রি ও গরুর ফার্মের বর্জ্যে ২২টি, গৃহস্থালি বর্জ্যে ৯টি ও ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্যরে পাঁচটি উৎসমুখ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে তরল ও কঠিন বর্জ্য পতিত হচ্ছে। তবে দূষণের এমন ৭৭টি উৎসমুখ আছে চট্টগ্রাম ও সিটি করপোরেশন এলাকায়। বাকি দুটি রাঙামাটি জেলায়। রাঙামাটিতে পোল্ট্রি ফার্মের কঠিন ও তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। চট্টগ্রামের ৭৭টি স্থানের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় ২২টি, রাউজানে ছয়টি, বোয়ালখালীতে ১০টি, কর্ণফুলীতে ১৫টি, আনোয়ারায় একটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি স্থানে দূষণ হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রবাহিত ২১টি ছোটবড় খালের মাধ্যমে গৃহস্থালী, শিল্প-কারখানা ও ডাইং ফ্যাক্টরির তরল ও কঠিন বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলীতে পড়ছে। এছাড়াও হাট-বাজার, গৃহস্থালী, তেলের দোকান, মাছের জ্বালানো তেল, খোলা টয়লেট, লবন ও চিনির মিল, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, জুট মিল, বরফ কারখানা, শুটকি পল্লী, অয়েল ট্যাংকার, পোল্ট্রি ও গরুর ফার্ম থেকে কঠিন ও তরল বর্জ্য ড্রেন, স্যুয়ারেজ লাইন ও সংযোগ খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে পড়ে। নদীতে চলাচলকারী বিভিন্ন নৌযানের তেল ও ময়লা ফেলার কারণেও নদী দূষিত হচ্ছে।
কয়েকটি স্পটে দূষণের মাত্রা বেশি উল্লেখ করে নদী কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে দূষণের মাত্রা বেশি। এই দুটি ইউনিয়নের নামাদামি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন কয়েকটি শুটকি পল্লী, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, সুগার মিল, বরফ মিলের বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ে। সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে মহেশখাল দিয়ে শহরের গৃহস্থালী ও পয়ঃপ্রণালীর তরল ও কঠিন বর্জ্য নদীতে পড়ে। শালিকের জোড়া খাল, নমুনা বাজারের খাল, মনোহর খালি খাল দিয়ে গৃহস্থালী, হাট-বাজার, পয়ঃপ্রণালী, ইঞ্জিন চালিত নৌযানের বর্জ্য ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে নদীতে পতিত হচ্ছে। এছাড়াও মাদারবাড়ি মৌজায় লবন ফ্যাক্টরির ৬-৭টি ড্রেন দিয়ে বর্জ্য নদীতে পড়ে। চাক্তাই খাল, নতুন চাক্তাই খাল, নতুন ফিশারিঘাট খালের গৃহস্থালী, পয়ঃপ্রণালী, মাছের বাজার ও ইঞ্জিনচালিত নৌযানের বর্জ্য ও প্লাস্টিক দ্রব্যাদি কর্ণফুলীতে যায়। ফিরিঙ্গিবাজার মৌজার চাক্তাই খালে শিল্প কারখানার কেমিক্যালযুক্ত পানি কর্ণফুলীকে দূষণ করছে। চর মোহরা ও মোহরা মৌজার চিটাগাং জুট মিল সংলগ্ন খাল ও কালুরঘাট ব্রিজ সংলগ্ন খালের আশপাশের বাড়িঘরের গৃহস্থালী বর্জ্য, বিসিক শিল্প নগরী, ট্যানারী, ফ্যাক্টরি, কপার মিলের কেমিক্যালের দূষণযুক্ত বর্জ্য ড্রেন, সংযোগ খাল ও স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে প্রতিনিয়ত নদীতে পড়ছে।

নদী কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, চিহ্নিত শিল্পকারখানাগুলি আধুনিক প্রযুক্তির ইটিপি স্থাপনের মাধ্যমে কারখানার উৎপাদিত বর্জ্য পরিশোধণ করার পাশাপাশি উৎপাদনের সময় সার্বক্ষণিক ইটিপি চালু রাখতে হবে। ইটিপি স্থাপন বা পরিচালনা না করলে পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের খাল ও পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য নদীতে পড়ার আগে পরিশোধন করার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী দূষণকারী পোল্ট্রি ও গরুর ফার্মগুলি তাদের উৎপাদিত বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদনের ব্যবস্থা নিলে নদী দূষণ বন্ধের পাশাপাশি জৈবসার ব্যবহারে পরিবেশ রক্ষা পাবে। নদী দূষণকারী হাট-বাজারের ইজারাদার কর্তৃপক্ষকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা আরোপের পাশাপাশি ইজারা চুক্তিতে হাট-বাজারের বর্জ্য নদীর তীরে স্তূপ করলে দÐনীয় অপরাধ বলে উল্লেখ করতে হবে। অন্যথায় চুক্তি বাতিল করতে হবে। গৃহস্থালীর দূষণ কমাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচুর জনসচেতনতার ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ সুপার, পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন। তবে গত নভেম্বর মাসে নদী রক্ষা কমিশন কর্ণফুলী নদী রক্ষায় এমন সমীক্ষা চালালেও তা বাস্তবায়নে বড় ধরনের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এখনো নদীর উৎসমুখগুলোতে দূষণ বন্ধ হয়নি।

নদী গবেষক প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী চট্রলার কণ্ঠকে  বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী দখল ও দূষণমুক্ত রাখা এটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। লেগে থেকেই কর্ণফুলীকে দূষণমুক্ত করতে হবে। কর্ণফুলী নদী সাধারণ কোন নদী নয়। এটি ঐতিহ্য ও অনুভূতির নদী। এ নদী আছে বলেই বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনছে। একসময় কর্ণফুলী ছিল দেশের প্রবেশদ্বার। বহিবাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এ নদী দিয়ে হয়। দেশের অর্থনীতিতে কর্ণফুলী বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ এই নদীকেই আমরা বহুমাত্রিক দূষণে আক্রান্ত করছি। চসিক, শিল্পকারখানাগুলো এ নদীকে দূষিত করছে। চট্টগ্রামের ১৭টি শিল্পজোনের বর্জ্য এ নদীতেই পড়ছে। হাটবাজারের পলিথিন যাচ্ছে নদীতে। আন্তঃসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। প্রতিটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করতে না পারলে কর্ণফুলীকে বাঁচানো যাবে না। পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীকেই দৃষ্টি দিতে হবে। নয়তো এ কর্ণফুলীকে সবাই ব্যবসার উপাদান বানাবে। রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসবে না।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক