জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশব্যাপী কোটি কোটি টন পণ্য পরিবহন ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সময় থেকেই এই বাড়তি দর কার্যকর হবে। শুধু অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতই নয়, একই সাথে প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির এই ঘটনা দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই মারাত্মক রকমের প্রভাব ফেলবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার গত ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা, ডিজেল-কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা ঘোষণা করে। দেশে পেট্রোল এবং অকটেনের ব্যবহার সীমিত হলেও লাখ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে পেট্রোল এবং অকটেন পাওয়া গেলেও ডিজেল কেরোসিনসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের পুরোটাই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয়। গতবছর দেশে ৬৩ লাখ টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছিল। এরমধ্যে ৪৬ লাখ টনই ছিল ডিজেল। এছাড়া ৫ লাখ ৫৯ হাজার টন ফার্নেস অয়েল, ৩ লাখ টন অকটেন, ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন পেট্রোল এবং ১ লাখ টনের বেশি কেরোসিন ব্যবহৃত হয়।
দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৩ শতাংশই ডিজেল। এই ডিজেলের উপরই দেশের কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদনসহ জীবনযাত্রার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে। দেশের গণপরিবহন, অভ্যন্তরীণ নৌ-সেক্টর, শিল্প কারখানার জেনারেটর, ডিজেল নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র লাখ লাখ টন ডিজেল ব্যবহার করে। প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য এক লাফে ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকায় নিয়ে যাওয়ায় এসব খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪ টাকা মূল্যবৃদ্ধি প্রতিটি সেক্টরেই মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এবং বন্দরের ওভার সাইড থেকে হাজার দেড়েক লাইটারেজ জাহাজ বছরে অন্তত ৮ কোটি টন পণ্য পরিবহন করে। চট্টগ্রাম থেকে দেশের অন্তত ২৫টি গন্তব্যে সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, খাদ্যশস্য এবং জ্বালানিসহ নানা পণ্য পরিবাহিত হয়। এক একটি লাইটারেজ জাহাজ প্রতি ট্রিপে আড়াই হাজার থেকে পাঁচ হাজার লিটার পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার করে। এতে করে আগে যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় করে একটি জাহাজ গন্তব্যে যাতায়ত করতে পারতো এখন ঠিক একই দূরত্বে যেতে প্রায় দেড়গুন টাকা ব্যয় করতে হবে। যা ভাড়ার সাথে সমন্বয় করা হবে মর্মে ইতোমধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) গতকাল শনিবার এক সার্কুলারের মাধ্যমে জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের জানিয়ে দিয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে অচিরেই একটি সভা করা হবে। যাতে জ্বালানি তেলের দামের সাথে সমন্বয় করে ভাড়া পুননির্ধারণ করা হবে। বর্ধিতভাড়া ৬ আগস্ট থেকে বরাদ্দকৃত সকল জাহাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। ডব্লিউটিসির কনভেনর নুরুল হক স্বাক্ষরিত পত্রটিতে জাহাজ ভাড়া ভাড়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা হয়েছে। সূত্র বলেছে, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তা পণ্যমূল্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দামই বৃদ্ধি পাবে।
এই ব্যাপারে গতকাল একাধিক জাহাজ মালিক দৈনিক আজাদীকে বলেছেন, ডিজেলের মূল্য একলাফে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে বিদ্যমান ভাড়া দেড়গুন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ আগে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে প্রতি টন পণ্য পরিবহন করতে ব্যয় হয় ৪৭৮ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে গেলে এই ভাড়া ৬শ টাকার উপরে চলে যাবে। শুধু জ্বালানি তেলই নয়, সাথে শ্রমিক কর্মচারীদের বর্ধিত বেতন ভাতার বিষয়টিও সমন্বয় করতে হবে। সবকিছু মিলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি জীবনযাত্রায় সরাসরি ধাক্কা দেবে।
ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত একজন পণ্যের এজেন্ট বলেছেন, যেভাবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে তাতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে। যার যোগান দিতে হবে আমদানিকারকদের। কিন্তু কার্যতঃ এই টাকার যোগান ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা হবে।
এই ব্যাপারে ডব্লিউটিসির কনভেনর নুরুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জাহাজ ভাড়া না বাড়িয়ে তো কোনো উপায় নেই। যেটা বাড়ানো হবে সেটা আজ (৬ আগস্ট) থেকেই কার্যকর হবে। আমরা সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। যেটা সবার জন্য কল্যাণকর সেটাই আমরা করবো। আগে আমরা ভাড়া কমিয়েছি। তবে এবার আর সেই সুযোগ নেই। ভাড়া বাড়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ডব্লিউটিসির প্রধান নির্বাহী মাহবুব রশীদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম ৪১.৫২ শতাংশ বেড়েছে। একটি জাহাজ শুধু ঢাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রেই তেল খাতে বাড়তি ব্যয় হবে এক লাখ টাকারও বেশি। এই টাকার সমন্বয় না করে কোনো জাহাজ মালিকের পক্ষেই জাহাজ পরিচালনা সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আগে ভাড়া কমিয়ে দিয়ে বহু জাহাজ মালিকই বড় ধরনের সংকটে পড়েছেন। এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারটি সমন্বয় না করলে এই সেক্টর টিকে থাকা কঠিন হবে।