নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনায় আয়োজিত সভায় উপস্থিত না থাকায় সিডিএর দুই নির্বাহী প্রকৌশলীর ‘অসহযোগিতা’র কথা তুলে ধরে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দুই প্রকৌশলী হচ্ছেন জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আহমদ মঈনুদ্দীন এবং উপ–প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) কাজী কাদের নেওয়াজ।
গতকাল রবিবার দুপুরে নগরের সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত ওই পর্যালোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম। এতে জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), সিডিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করার জন্য সরেজমিনে প্রকল্প পরিদর্শন করার লক্ষ্যে গঠিত ১২ সদস্যের কমিটিকে সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া মেগা প্রকল্পের আওতায় শেষ হওয়া ১৬ খাল সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া এবং মেগা প্রকল্পে অর্থ সংকটের বিষয়ে আলোচনা হয়। শেষ হওয়া ১৬ খালের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বানের প্রস্তাব করা হয় চসিকের পক্ষ থেকে। এছাড়া খাল–নালায় যারা ময়লা–আবর্জনা ফেলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা জোরদার করা নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া আউটার রিং রোডে প্রকল্পে পর্যাপ্ত স্ল্যুইচ গেইট না রাখায় নগরের একাংশে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হয়। এ বিষয়ে বলা হয়, সাতকানিয়ায় জলাবদ্ধতার জন্য রেললাইনের বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার একটা কারণ এয়ারপোর্ট থেকে আউটার রিং রোড হতে পারে। সেখানে ১৫–১৬টি পানি যাওয়ার রাস্তা ছিল। এখন আউটার রিং রোড হওয়ার পর ৫–৬টা হয়ে গেছে।সভার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম চট্টলার কণ্ঠকে বলেন, জলাবদ্ধতা যাতে না হয় সেজন্য সমন্বয় করে যেন কাজ করেন সে আলোচনা হয়েছে। যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তাদের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। ১৬ খাল নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ১৬ খাল বুঝে নেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খালগুলো কোন পর্যায়ে আছে কমিটি দেখবে। এরপর বুুঝে নেওয়ার বিষয়ে বলা হবে। মেগা প্রকল্পের পিডি–ডিপিডি উপস্থিত না থাকা প্রসঙ্গে তিনি আজাদীকে বলেন, না বলে মিটিংয়ে কেন ছিলেন না তা নিয়ে কথা হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি মাসে টানা চার দিনসহ মোট পাঁচ দিন অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের প্রভাবে জলাবদ্ধতা হয়েছে। ১১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চললেও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় চলে নানা আলোচনা–সমালোচনা। বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। এর প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার একটি সভা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এরই ধারাবাহিকতায় গতকালের সভা হয়। এছাড়া আজ সোমবার চসিক কার্যালয়ে আরেকটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পের অগ্রগতি কতটুকু : গতকালের সভায় চলমান চারটি প্রকল্পের অগগ্রতি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ শতাংশ। সংস্থাটির ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৬৯ শতাংশ।
সিটি কর্পোরেশনের ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকার ‘বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল নতুন খাল খনন’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয় ৫৮ শতাংশ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।
যা আলোচনা হয়েছে : সভায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী চট্টলার কন্ঠকে বলেন, ১৬ খালের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। খালগুলো সিডিএকে বুঝিয়ে দিতে চিঠি দেওয়া হবে। পরে সিডিএ চসিককে খালগুলো বুঝিয়ে দেবে।
এ সময় বিভাগীয় কমিশনার সিডিএর প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য জানতে চান। তখন উপস্থিত অন্যরা আসেননি বলে জানালে বিভাগীয় কমিশনার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা থাকতে পারবেন না শুনে তারিখ পিছিয়ে আজকে সভা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন তারা নেই কেন? সভা থেকে উপস্থিত একজন জানান, প্রকল্প পরিচালক মন্ত্রণালয়ে গেছেন। তখন বিভাগীয় কমিশনার বলেন, চট্টগ্রাম বৃষ্টির পানিতে ডুবে আছে। এটি এখানকার বড় সমস্যা। সারা বাংলাদেশ এটি নিয়ে কনসার্ন। জনগণ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সবাই জানতে চাচ্ছেন। যদি রেসপনসিবিলিটি, অ্যাকাউনটিবিলিটি না থাকে তাহলে তো তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এটা তো তার টাকা না। আমার টাকা আমি খেয়ে ফেললাম, কাজ করলাম না। জনগণের টাকা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেই জবাবদিহিতার জন্য আমরা বিভিন্ন কাজ রেখে এখানে এসেছি। সে নাই কেন? ঢাকার চেয়ে এটা কি কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ? কাজ হচ্ছে এখানে, পিডি থাকবে ঢাকায়? প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের কাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, পিডি ঢাকায় থাকতে পারবে না। যেখানে কাজ হবে সেখানে থাকবে। গত মিটিংয়ে না হয় গেল ঢাকায়। আজকেও ঢাকায়। তাহলে আমরা কার কাছ থেকে এটার বাস্তব অবস্থাটা জানব? সভার কার্যবিবরণীতে এই অবহেলা এবং তার কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে মন্ত্রী পরিষদ এবং মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।
সভায় উপস্থিত না থাকা প্রসঙ্গে জানার জন্য পিডি আহমদ মঈনুদ্দীন ও ডিপিডি কাজী কাদের নেওয়াজের মোবাইলে কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি।
এদিকে সভায় খাল বুঝে নেওয়া নিয়ে চসিকের প্রতিনিধিরা আপত্তি জানান। এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম চট্রলার কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের পিসিআর (প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন) না হওয়া পর্যন্ত বুঝে নিতে আমাদের আপত্তির কথা জানিয়েছি। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বানের প্রস্তাব করি।
সভায় অন্য কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১২ সদস্যের যে কমিটি আছে সেটাকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া খালে ময়লা ফেললে এনফোর্সমেন্ট জোরদার করতে আলোচনা হয়।
জানা গেছে, সভায় চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম পিসিআর পাওয়ার আগে খাল বুঝে নিলে আইনগত জটিলতা তৈরি হবে বলে জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খাল পরিদর্শনের জন্য গঠিত ১২ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) এবং সদস্য সচিব হচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী।