যেকোনো ঘাতক ব্যাধি থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আত্মহত্যা। চট্টগ্রামে আত্মহত্যা বাড়ছে। এর মধ্যে নগরের বন্দর ও ইপিজেড এলাকায় আত্মহত্যার হার বেশি। সবচেয়ে কম খুলশীতে। পারিবারিক কলহ, আর্থিক অনটনসহ নানা কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তরুণদের মাঝে এই হার বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রতি বছরই বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যা। ২০২১ সালে নগরীতে ৩৯৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২৬ জনে। এর মধ্যে নগরীতে আত্মহত্যা করেছে ২৫৯ জন। একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ভাবাচ্ছে পুলিশকে। তাদের ধারণা, ২০২২ সালের চেয়ে চলতি বছরে আত্মহত্যার ঘটনা আরও বেড়ে যাবে।
আত্মহত্যার কারণ সবসময় একটা হয় না। স্কুল–কলেজে পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে এই হারটা বেশি। নগরীর সদরঘাট থানাধীন পোস্ট অফিস গলি এলাকায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে গত শনিবার রিমঝিম দাশগুপ্ত (২০) নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার কলেজ থেকে আসার সময় এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র হারিয়ে ফেলে ওই শিক্ষার্থী। নগরের ইপিজেড এলাকায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তিন বছরের শিশুসহ এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন গতকাল। ইপিজেড থানা সংলগ্ন ব্যাংক কলোনির শাহ আলম কন্ট্রাক্টরের ভবনে এ ঘটনা ঘটে। ২৪ আগস্ট একই কারণে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নে নুর আয়েশা বেগম (৪০) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন।
চট্টগ্রাম নগরীতে ২০২২ সালে ২৫৯ ঘটনার মধ্যে ১৪২ পুরুষ ও ১১৭ নারী স্বেচ্ছায় জীবন দিয়েছেন। নগরে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা বেশি বন্দর–ইপিজেড এলাকায়। এখানে এক বছরে ৪৩ পুরুষ ও ৩৪ নারী এ পথে হেঁটেছেন। এর পেছনে খুঁজে পাওয়া গেছে ১১ কারণ। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক কলহ, স্বামী–স্ত্রী ঝগড়া, আর্থিক অনটন, জীবিকার সংকট ও অনিশ্চয়তা, ঋণ পরিশোধ, প্রেমঘটিত বিবাদ, মা–বাবার সঙ্গে অভিমান, হতাশা, যৌতুক ও মানসিক বিষাদ। এর পরের অবস্থান বন্দর থানার। বন্দর এলাকায় তুচ্ছ পারিবারিক বিষয় নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। এখানে মূলত পারিবারিক অশান্তি তথা স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়া, আর্থিক টানাপোড়ন, ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।
তবে এর বিপরীত ছবি খুলশীতে। অভিজাত এ এলাকাটিতে এক বছরে আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি। আত্মহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন থানার নথি ও পুলিশের সূত্র থেকে এসব তথ্য মিলেছে।
আত্মহত্যা নিয়ে চট্টগ্রামের এক এনজিওর পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, পারিবারিক সমস্যায় ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বৈবাহিক সমস্যায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক নিয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, স্বামীর নির্যাতনে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অর্থকষ্টে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ নারী–পুরুষ আত্মহত্যা করেন।
চট্টগ্রাম নগরে ১৬ থেকে ২৫ বয়সের তরুণদের হতাশা বেশি। পিছিয়ে নেই তরুণীরাও। শুধু এক বছরে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৬৫ তরুণ এবং ৫৮ তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নেন। এছাড়া ১০ থেকে ১৫ বছরের আট কিশোর ও ১৪ কিশোরী, ২৬ থেকে ৩৫ বছরের ২৬ পুরুষ, ২৮ নারী, ৩৬ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৩ পুরুষ ও ১৭ নারী নিজের প্রাণ নিজেই হরণ করেন।
সম্প্র্রতি অনেক কিশোর–কিশোরী আত্মহত্যাকে ট্রেন্ড হিসেবে অনুসরণ করছে। মোবাইল ফোন অথবা শখের মোটর বাইক কিংবা অন্য কোনো শখের বস্তু কিনে না দেওয়ায়ও অনেক কিশোর বয়সীর আত্মহত্যার খোঁজ পাওয়া যায়। এমনকি যেকোনো পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে না পেরেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। মোটামুটি বয়স্ক মানুষও আত্মহত্যা করতে পিছপা হয় না। তাদের আত্মহত্যার কারণগুলো হয়ে থাকে ব্যক্তিগত জীবনে একাকীত্ব, পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি, ঋণগ্রস্ততা, পরিবারে অভাব মুছনে ব্যর্থতা ইত্যাদি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই যবনিকাপাত ঘটে। পুলিশের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি আত্মহত্যার মামলাগুলো তদন্ত করা যায় তাহলে বেশিরভাগ আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এ ব্যাপারে চট্টলার কন্ঠকে বলেন, প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়ে যায়। এটা পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে কী করা যায় তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। আশা করছি দ্রুত এর সুফল আসবে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন চট্রলার কণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। শুধু চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় গত বছর ৫২৬ জনের আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডের বাইরেও নিশ্চয় রয়েছে। এছাড়া জেলায় কতগুলো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা শিউরে ওঠার মতো।
তিনি বলেন, আত্মহত্যা যারা করেছে তারা নিশ্চয়ই বিস্বাদ থেকেই করেছে। এ বিস্বাদের পেছনে পারিবারিক বিরোধ, পড়ালেখার চাপ, মোবাইল কেনা, যৌতুক নিয়ে স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব সমস্যা দূর করার বিষয়ে আমরা কোনো কাজ করছি না। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনী ব্যবস্থার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই আত্মহত্যা কমে আসতে পারে।