বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি–একাডেমিয়া কোলাবোরেশন শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো আমাদের রিসোর্সের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু সেই সীমিত রিসোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে একজন শিক্ষার্থী তার চিন্তাভাবনাকে লালন করে সেটাকে পূর্ণতা এনে দিতে পারে।
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ২১তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটরিয়ামে আয়োজিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার ছিলেন চুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম। প্রধান বক্তা ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক।
এতে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সুনীল ধর, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. মইনুল ইসলাম, পুরকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমাল পাল এবং তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন যন্ত্রকৌশল অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। বিভাগীয় প্রধানগণের পক্ষে এমআইই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন আহাম্মদ, হল প্রভোস্টগণের পক্ষে সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোছাঃ ফারজানা রহমান জুথী, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম, কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ ইকরাম, স্টাফ এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জামাল উদ্দীন এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান, ফাইরুজ তাসনীম রুহিয়া ও আশরাফুল আলম তানিম বক্তব্য রাখেন।
ইইই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সম্পদ ঘোষ, ইটিই বিভাগের প্রভাষক প্রিয়ন্তি পাল টুম্পা ও এমআইই বিভাগের প্রভাষক তাসমিয়া বিনতে হাই–এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে চুয়েটের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করেন উপ–পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা) মোহাম্মদ ফজলুর রহমান।
চুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, চুয়েট মাত্র দুই দশকের পথচলায় দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা–সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দেশ–বিদেশে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়েও আমাদের অবস্থান সুসংহত হয়েছে। সবার সহায়তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই। আজকের এইদিনে আমি সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
প্রধান বক্তা দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, গণমাধ্যমের নীতি হচ্ছে শুধুই কাজ করে যাওয়া। স্বীকৃতির আশায় আমরা বসে থাকি না। দৈনিক আজাদী ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমার বাবা মরহুম আবদুল খালেক ছিলেন এতদঞ্চলের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার। এ বছর আমার বাবার ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রি অর্জনের একশ বছর পূর্তি হচ্ছে। তিনি ১৯২৩ সালে ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বিএসসি করেছিলেন। বাবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় নিজের ভিতরে ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি অন্যরকমের মমত্ববোধ কাজ করে।
দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের ব্যাপারে সবসময় আপসহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৩ সালের আগ থেকে তৎকালীন বিআইটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলন চলছিল। চট্টগ্রামের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক আজাদী শুরু থেকে বিআইটিকে চুয়েটে রূপান্তরের আন্দোলন–সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। চুয়েট মেধাবীদের উর্বর ভূমি এবং আমরা যারা চট্টগ্রামে থাকি, তারা কি কেউ অস্বীকার করতে পারব যে এ অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে চুয়েট শিক্ষকদের গবেষণার কথা? মিডিয়ার মানুষ বলেই আমি জানি, প্রতিটি দুর্যোগে–দুর্বিপাকে, নগর ব্যবস্থাপনায়, নগর উন্নয়নে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতামত কতটুকু মূল্যবান, তাদের পরামর্শ কতটুকু অর্থবহ। আমি বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশের যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন, তা বাস্তবায়নেও চুয়েটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকা থাকবে।
নিজের জন্মস্থান রাউজানে চুয়েটের অবস্থান উল্লেখ করে এম এ মালেক বলেন, যখন আমি ভাবি চুয়েট বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাংকিংয়ে ২য় সেরা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৩য় সেরা, তখন আনন্দে আমার বুকটা ভরে যায়। যখন শুনি, চুয়েটের কোনো শিক্ষার্থী গুগল, ফেইসবুক বা অন্য কোনো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েছে, কিংবা চান্স পেয়েছে ইউরোপ–অস্ট্রেলিয়ার কোনো নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন নিজের সন্তানের সাফল্যের মতোই আমার আনন্দ হয়। গর্বে বুক ভরে যায়। চুয়েটের যেকোনো অর্জনে তাই আমরাও আনন্দিত হই। চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও পরিকল্পনায় চুয়েটের আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজাদী সামনের দিনগুলোতেও চুয়েটের সকল প্রয়োজনে পাশে থাকবে।
আলোচনা শেষে চুয়েট মেডিকেল সেন্টারে রক্তদান কর্মসূচি এবং পরে শিক্ষক বনাম ছাত্র এবং কর্মকর্তা বনাম কর্মচারী প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন–২ এর সামনে থেকে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পরে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেন অতিথিবৃন্দ।
২১তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষ্যে বর্ণাঢ্য আনন্দ র্যালি রেব হয়। র্যালিতে রঙ–বেরঙের বাঁশি, ভুভুজেলা ও ঢাকঢোল বাজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীগণ অংশগ্রহণ করেন। পরে কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়াম সংলগ্ন এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় দিবস–২০২৩ এর স্মারক বৃক্ষরোপণ করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা–গবেষণার একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চুয়েট আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির অধীনে ১৯৬৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই স্বায়ত্বশাসিত বিআইটি চট্টগ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চুয়েটে বর্তমানে ১২টি বিভাগে ৯২০টি আসনের (উপজাতি কোটাসহ ৯৩১ আসন) বিপরীতে স্নাতক পর্যায়ে ৪ হাজার ৮০০ জন এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১২শ জনসহ প্রায় ৬ হাজার জন ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। এছাড়া ১০১জন পিএইচডি ডিগ্রিধারীসহ প্রায় ৩৪০ জন শিক্ষক, ১৭০ জন কর্মকর্তা এবং ৪৬০ জন কর্মচারী নিয়ে কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে।