ডিসেম্বর ৪, ২০২৪ ১০:০৫ পূর্বাহ্ণ

হালদায় ডিম ছাড়ল মা মাছ

সবুর হোসেন।

হালদায় ডিম ছাড়লো মা মাছ
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে কার্পজাতীয় মা মাছ। অপেক্ষায় থাকা আহরণকারীরা একেকটি নৌকায় ২০ থেকে ২৭ কেজি ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। আবার কোনোটিতে তারও বেশি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সঠিক পরিমাণ বের করতে আরেকটু সময় লাগবে।

মঙ্গলবার (৭ মে) ভোর ৬টার দিকে ভাটা শেষে হালদার রাউজান অংশের মইশকরম এলাকার চইল্যাখালি অংশে ১১টি নৌকায় এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়।

এর আগে, সোমবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত মা মাছ নদীর বিভিন্ন স্থানে ডিম ছাড়ে।

ডিম সংগ্রহকারী পাকিরাম দাশ, হরিরন্জন দাশ, সন্তোষ দাশ, সুজিত দাশ ও সুনিল দাশ জানান, তাঁরা প্রায় ১১টি নৌকায় ডিম সংগ্রহ করেন। এতে প্রতিটি নৌকায় দুই থেকে আড়াই বালতি (এক বালতিতে ১০ কেজি) আবার অনেকগুলোতে প্রায় ৩ বালতি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করেন। সবমিলিয়ে আনুমানিক ২৮ বালতির বেশি কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এবার ১১টি নৌকায় প্রতিটিতে দুজন করে ২২ জন লোক নিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি নৌকায় দুই থেকে আড়াই বালতি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। সে হিসাবে ১১টি নৌকায় প্রায় ২২০ থেকে ২৭৫ কেজি পর্যন্ত কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহ করা গেছে। তবে অনেক নৌকায় তিন বালতির বেশি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে। তাই সব মিলে সঠিক পরিমাণ বের করতে একটু সময় লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগেই বলা হয়েছিল— যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকে অর্থাৎ বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তাহলে চলতি মাসের (মে) অমাবস্যার জোঁ (৬ মে থেকে ১০ মে) অথবা পূর্ণিমার জোঁ’তে (২০ মে থেকে ২৫ মে) হালদা নদীতে মেজর কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলেই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। গড়ে ৫শ’-৬শ’ জন স্থানীয় সংগ্রহকারী এসব ডিম সংগ্রহ করে মাটির তৈরি কূয়া বা হ্যাচারীতে ফুটিয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন পোনা উৎপাদন করে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হালদার মৎস্য সম্পদের ওপর। এর প্রভাবে বিগত কয়েক বছর হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমেছে।’

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম।

বর্তমানে হালদা নদীতে মেজর কার্পজাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম চলছে জানিয়ে ড. শফিক বলেন, ‘হালদা নদীতে চলছে মেজর কার্পজাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা (৫০ বছরের মধ্যে অধিক) ও ব্রজসহ বৃষ্টিপাতর অভাবে হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় বিগত এপ্রিল মাসের দুটি জোঁ’তে (অমাবস্যার ও পূর্ণিমার) ডিম ছাড়েনি কার্পজাতীয় মা মাছ।’

গত ১ মে (বুধবার) হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্র মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী কিনা জানতে হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ড সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করেন শফিক। তা সরাসরি হালদা নদীতে ও বাসার নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করে তিনি দেখেন, পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের আদর্শ মানের মধ্যে রয়েছে। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার পানির তাপমাত্রা আদর্শমান ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে ৩৩ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়েছে।

এই হালদা গবেষক বলেন, ‘মেজর কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মেজর কার্পজাতীয় মাছের জন্য অত্যানুকূল পানির তাপমাত্রা হচ্ছে (২২-৩০) ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এরা অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বৃষ্টিপাত হলেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।’

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি এবং ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহের প্রকৃত তথ্য নিয়ে গরমিলের অভিযোগও পাওয়া যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনে বা ঋতু পরিবর্তনসহ নানা কারণে হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার স্থান কমে যাচ্ছে। গত বিশ বছরেও যেখানে প্রায় বার থেকে পনেরটি ডিম ছাড়ার স্থান ছিল তা বর্তমানে চার থেকে পাঁচটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ভাসান জাল কিংবা ঘেরা জাল বসিয়ে অহরহ মা মাছ নিধন করা হচ্ছে। যদিও প্রশাসন নিয়মিত অভিযান বা নজরদারিতে রাখছে। কিন্তু পরিবেশ অনূকুলে না থাকায় অনেক সময় মা মাছ ডিম না ছেড়ে তার পেটেই রেখে দেয় আর এতে দূরদূরান্ত থেকে ডিম ছাড়তে আসা মা মাছ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক