ডিসেম্বর ৩, ২০২৪ ৬:৩৭ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের “চোরা মার্কেট”

চট্টগ্রাম রেল স্টেশন কেন্দ্রিক মাদকের আস্তানা ধ্বংস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে নতুন করে ভাবনায় পড়েছে তারা। খুচরা মাদক বিক্রেতাদের পাশাপাশি এখন রেল স্টেশন এলাকা হয়ে উঠেছে চোরাই পণ্য কেনা বেচার নিরাপদ আখড়া। গত এক মাসে নগরীতে ছিনতাই ও চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত চোর ও ছিনতাইকারীরা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, চুরি বা ছিনতাইয়ের পর চোরাই পণ্য বিশেষ করে মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী বিক্রির যাবতীয় লেনদেন চলে রেল স্টেশন এলাকায়। গত ২ সেপ্টেম্বর  রাতে নগরীর রিয়াজউদ্দীন বাজার, রেলস্টেশন ও দেওয়ান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৬৬টি চোরাই মোবাইল, ৯টি ল্যাপটপ, আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত ৯টি ডিভাইস, ৭টি ফ্লাশিং ডিভাইস উদ্ধার করেছে ডিবি উত্তর বিভাগ। গ্রেপ্তার ৬ জন চার বছর ধরে এ কাজ করছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
সিএমপি মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন থেকে খোরশেদ ও কামালকে ৪টি মোবাইলসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে খোরশেদ ও কামালের তথ্যের ভিত্তিতে রিয়াজউদ্দীন বাজার, দেওয়ান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ চুরির পর তা রেল স্টেশন এলাকায় চলে আসে, দরদামসহ যাবতীয় বিষয় সম্পন্ন হয় স্টেশন এলাকায়।
কোতোয়ালী থানার ওসি মো. জাহিদুল কবীর বলেন, রেল স্টেশন এলাকায় আমাদের থানার সার্বক্ষণিক একটি টিম মোতায়েন থাকে। এছাড়া সিভিলেও একটি টিম দায়িত্ব পালন করে। একের পর এক চোর ছিনতাইকারীরা যে ধরা পড়ছে, তাতেই আমাদের তৎপরতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো জামিনে এসে তারা একই কায়দায় পুরনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
টিকিট কালোবাজারি, মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রয়, পতিতাবৃত্তি, স্বর্ণপাচার, ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা নিত্যদিন ঘটছে না চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে। বলা যায় অপরাধীদের নিরাপদ সাম্রাজ্য। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের সাথে দারুণ সখ্যতা রয়েছে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যের। নিয়মিত মাসোহারা সুবিধাও নিয়ে থাকেন তারা।
স্টেশন এলাকার লোকজন জানান, রেলওয়ে স্টেশনে অপরাধ এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত স্টেশন এলাকায় অবাধে বিচরণ করে পতিতারা। দিনভর চলে মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবাসহ সকল প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রয়। আর রাতদিন ২৪ ঘণ্টা চলে টিকিট কালোবাজারি। লোকজনের অভিযোগ, রাত ও দিনে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড আর অপরাধীদের দৌরাত্মে স্টেশন এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা একেবারে  নষ্ট হয়ে গেছে। যাত্রীসাধারণ থেকে ব্যবসায়ী পর্যন্ত কেউ এদের কাছ থেকে নিরাপদ নয়। নিরাপদে আছে শুধু অপরাধীরা।
নতুন রেল স্টেশনের প্রবেশপথ থেকে পুরনো স্টেশনের ফুটপাত পর্যন্ত বেচাকেনা চলে ছিনতাইয়ের পণ্য। মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিকসের নানা জিনিসপত্র বিক্রি হয় একেবারে কম দামে। সেখানে ১০ হাজার টাকায় পাওয়া যায় আইফোন। অ্যান্ড্রয়েড মিলে দুই থেকে তিন হাজারের মধ্যে। এসব মালামাল কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা বলেন, সবই বুঝেনতো। আমার মুখ থেকে শুনে আর কী হবে? এই ব্যবসায় ঝামেলা কেমন জানতে চাইলে সে জানায়, কারো দামি কোনো জিনিস চুরি-ছিনতাই হলে স্টেশন রোডে এসে খোঁজ নেয়। পাওয়া গেলে ঝামেলা হয়। মাঝে-মধ্যে পুলিশও ঝামেলা করে।
স্টেশন এলাকায় ভাসমান এমন কয়েকজন বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, চোরাই মার্কেটের সব পণ্যই চুরির নয়। প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরে ছিনতাই ও ডাকাতি হওয়া মালামালও এখানে এনে বিক্রি করা হয়। বিত্তবান ঘরের মাদকাসক্ত ছেলেরা নেশার টাকা যোগাতে বাসার বিভিন্ন মালামাল এনেও বিক্রি করে দেয়। দোকানগুলোয় গিয়ে লক্ষ করা গেছে, মোবাইল, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরসহ বৈদ্যুতিক ফ্যান, মোবাইল, ঘড়ি, নানা ধরনের ক্যালকুলেটর, ক্যালেন্ডার, জুতা, স্যান্ডেল প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে।
কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে ইতোপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত চুরির জগতে ‘স্পাইডার ম্যান’ খ্যাত চোর রতন জানায়, সে চুরির পরপরই স্টেশন রোড এলাকায় মালামাল বিক্রি করে থাকে। তার মতে ছিনতাই-চুরির কাজে ভাসমান মানুষদের মদদ দিয়ে আসছে এই এলাকার চোরাই পণ্যের ক্রেতারা। স্টেশন রোড এলাকায় ভাসমান শিশু ও লোকজনদের টার্গেট করে প্রথমে মাদকে আসক্ত করানো হয়। এরপর মাদকের টাকা সংগ্রহে বাধ্য হয়ে ছিনতাই ও চুরি-ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। সে নিজেও মাদকের টাকার জন্যই চুরি পেশায় জড়িয়েছে বলে জানায়।
একটা সময় চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার অদূরেই ছিল চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া বরিশাল কলোনি। এলাকাটি মূলত রেলওয়ের নিজস্ব জমি। সেটি উচ্ছেদ করার পরও মাদক ব্যবসা চলছে ভাসমান পদ্ধতিতে। পাশাপাশি চোরাই পণ্যের রমরমা ব্যবসাতো চলছেই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক