নিজস্ব প্রতিবেদক।
চট্টগ্রামের রাউজান আসনে পতিত স্বৈরাচারি সরকারের সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী জুনু ওরফে জুইন্ন্যাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে পুলিশ ও কারাপ্রশাসন। জনরোষ থেকে বাঁচাতে তাকে আদালতে আনা যাচ্ছে না। আবার কারাগারেও অন্য বন্দিদের কাছ থেকে তাকে দূরে রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার এই মাফিয়াকে সম্ভাব্য গণপিটুনি থেকে সুরক্ষা দিয়ে আদালতে আনা এবং রিমাণ্ডে নেওয়ার উপায় খোঁজা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন বিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর জুইন্ন্যাসহ চট্টগ্রামের মাফিয়ারা পাতালে চলে যায়। গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর পথে জুইন্ন্যাকে পাকড়াও করে বিজিবি। সেখানে তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে তার বিরুদ্ধে গুম, খুন অপহরণসহ ১০টির মতো মামলা হয়। কিন্তু এসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম আনা নিয়ে বিপাকে পড়ে পুুলিশ প্রশাসন। কারণ সড়ক পথে তাকে চট্টগ্রাম আনার পথে বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষের শিকার হতে পারেন জুইন্ন্যা এমন গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়।
ফলে প্রায় এক সপ্তাহ তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে রাখা হয়। এরপর গ্রেফতারের আটদিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার তাকে র্যাবের একটি হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম আনা হয়। ওইদিন বিকেলে কঠোর নিরাপত্তায় হেলিকপ্টারটি নগরীর দামপাড়ায় সুরক্ষিত পুলিশ লাইন্স মাঠে অবতরণ করে। সেখান থেকে র্যাব-পুলিশের নিরাপত্তায় তাকে প্রিজন ভ্যানে করে লালদীঘির পাড়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তাকে জনরোষ থেকে রক্ষা কিংবা যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সড়ক পথের বদলে আকাশ পথে চট্টগ্রাম আনা হয়। কারাগারের একটি সূত্র জানায়, কারা অভ্যন্তরেও তাকে কঠোর নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। কারণ অন্য কোন বন্দির রোষানলে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এদিকে জুইন্ন্যাকে কারাগার থেকে চট্টগ্রাম আদালতে আনা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে গত শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেও আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হন অনেকে। তাদের কারো হাতে ছিল ডিম এবং লাঠিসোটা, উত্তেজিত জনতার ভাবভঙ্গিমা ছিল অনেকটাই আক্রমণাত্মক। বিগত ১৭ বছর রাউজানে জুইন্ন্যা ও তার বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা তাকে আদালতে তোলার দিন সেখানে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাউজানেও জুইন্ন্যার ফাঁসির দাবিতে মিছিল, সমাবেশ অব্যাহত আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাউজান উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জুইন্ন্যা ও তার বাহিনীর লোকজন। মানুষের বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় জুইন্ন্যার লোকজন।
বিএনপি সমর্থিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমনকি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদেরও এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেন জুইন্ন্যা। বিএনপি জামায়াত কর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা, পুলিশ দিয়ে ক্রসফায়ার এবং গুম করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জুইন্ন্যা তার বাহিনীর নির্যাতনে বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া হন। আওয়ামী লীগ করেও জুইন্ন্যার অনুসারী না হওয়ায় এলাকা ছাড়া হন তৎকালীন সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের অনেকে। পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নেন জুইন্ন্যা। নির্বাচনের বদলে তার মনোনীত প্রার্থীদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিনা ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিনা ভোটে নির্বাচিতরা বিগত সাড়ে ১৫ বছর সরকারি তহবিলের টাকা লুটপাট আর নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। রাউজানে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এবং তাদের বাড়ি-ঘর দখলের অভিযোগও রয়েছে জুইন্ন্যা ও তার বাহিনীদের বিরুদ্ধে।
রাউজানে তার কথাই ছিল শেষ কথা। জুইন্ন্যা ধরা পড়ার পর তার সহযোগীরা এখন বোল পাল্টাতে শুরু করেছেন। তার ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন রাউজানের সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার বাবুল। সম্প্রতি তার ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে জুইন্ন্যার নানা অপকর্মের বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। অডিওতে বাবুলকে বলতে শোনা যায়, ‘ফেরাউন গেছে, রাউজান মুক্ত হয়েছে। পিংক সিটিতে আমার আট গণ্ডা জমি দখল করেছে।’ এছাড়াও বাবুলের অভিযোগ, ফজলে করিম একজন নারীকে ধর্ষণ করেছেন। তার গালাগালি শোনার পর একজন প্রকৌশলী স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ফজলে করিম বাগানবাড়ির জন্য ২০ কানি জমি কিনে বিক্রেতাদের কোনো টাকা দেননি।
ছাত্রদল নেতা নুরু, প্রবাসী বিএনপি নেতা মুসা হত্যাসহ জুইন্ন্যা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১০টির মতো মামলা হয়েছে। বাগোয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আবু জাফরকে গুমের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের ২৭ মার্চ খুলশী থানার ভূঁইয়া গলি থেকে জাফরকে তুলে নেওয়া হয়। ১৪ বছরে তার সন্ধান মেলেনি। এই গুমের ঘটনায় ২০২২ সালে লন্ডনভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমে সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে জড়িত হিসেবে ফজলে করিমের নাম শোনা গিয়েছিল। যার ভিত্তিতে ২৯ আগস্ট বাবার সন্ধান চেয়ে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করেন জাফর চেয়ারম্যানের ছেলে জিসানুর রহমান।
গুমের ঘটনায় ফজলে করিমকে দায়ী করে জিসানুর বলেন, ভিডিও বার্তায় লে. কর্নেল হাসিনুর রহমানের কণ্ঠে শোনা গেছে, ফজলে করিমের নির্দেশে বাবাকে গুমের পর খুন করতে হাসিনুর রহমানকে বলা হয়। কিন্তু তিনি (হাসিনুর) খুন করতে রাজি হননি। এই গুমের সঙ্গে সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানও জড়িত বলে অভিযোগ করেন জিসানুর। এসব মামলায় জুইন্ন্যাকে আদালতে হাজির করে গ্রেফতার দেখানোর (শ্যোন অ্যারেস্ট) আবেদন করা হবে। এরপর প্রত্যেকটি মামলায় তাকে রিমাণ্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান নগর ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে ভয়ংকর সন্ত্রাসী জুনুর কাছ থেকে গুম, খুন ও তার অস্ত্র ভাণ্ডারের তথ্য বের করে আনতে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল গঠন করে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি উঠে। তারা বলছেন, রাউজানের নব্য ফেরাউন খ্যাত এ সন্ত্রাসীকে ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার কাছ থেকে তথ্য বের করে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার পাশাপাশি তার গোপন অস্ত্র ভাণ্ডার উদ্ধার এবং ক্যাডার বাহিনীকে গ্রেফতার করতে হবে। রাউজানে দেড় দশক ধরে গুম, খুন, অপহরণসহ জুলুম নির্যাতনের শিকার লোকজন তার ফাঁসির দাবিতে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে চান। এ অবস্থায় তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনার ক্ষেত্রে বাড়তি নিরাপত্তার কথা ভাবতে হচ্ছে প্রশাসনকে। আজ সোমবার অথব আগামীকাল মঙ্গলবার তাকে আদালতে আনা হতে পারে।