নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রথমে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে খোলা হয় যৌথ হিসাব। ওই হিসাবের বিপরীতে নেওয়া হয় ঋণ। পরে ঋণ পরিশোধ না করে বাড়িয়ে নেন সময়সীমা। একটি দুটি নয়, এভাবে ৬ বছরে ১০টি হিসাবের বিপরীতে বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৪ কোটি টাকা লোপাট করেছে চারজনের চক্র। চক্রের দুজন ব্যাংকের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, দুজন ব্যবসায়ী।
শুধু তাই নয়, যৌথ সাক্ষরে হিসাব পরিচালনার কথা থাকলেও একজনের সাক্ষরেই করে নিতেন সব। অথচ বাকি অংশীদার জানতেনই না কিছুই!
প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে মোট ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এ চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপসহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন বাদি হয়ে নিজ কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার আসামিরা হলেন— স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখার সাবেক এভিপি ও ব্যবস্থাপক মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী (৫৭), একই শাখার এসইও অফিসার কাঞ্চন কুমার দে (৫৭), সাতকানিয়া উপজেলার চরখাগারিয়া গ্রামের ইব্রাহিম চৌধুরীর ছেলে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী (৫১) এবং নগরের ডবলমুরিং থানার বাংলাবাজার স্ট্যান্ড রোড এলাকার মৃত আমির হোসেনের ছেলে ইকবাল হোসেন দোভাষ (৬৯)।
ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই ছিল না
সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম চোধুরী ও কাঞ্চন কুমার দে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউ শাখায় দায়িত্ব পালনকালে ২০০৭ সালের ১৭ এপ্রিল মেসার্স এইচ এন্ড করপোরেশনের নামে একটি চলতি হিসাব (৩৩০০০৯৭৬) খোলেন। অন্য আসামি সাইফুল ইসলাম এবং ইকবাল হোসেনের ছেলে জাহিদকে ওই হিসাবের নমিনী উল্লেখ করা হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম ওই হিসেবের পরিচয়কারী ছিলেন।
ওই হিসেব খোলার পত্রে মো. আবদুস সবুর নামে এক ব্যবসায়ী এবং আসামি ইকবাল হোসেনকে মেসার্স এইচ এন্ড করপোরেশন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটার উল্লেখ করা হয়। আর প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘৮২, আসাদগঞ্জ, কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম’। অথচ ওই ঠিকানায় গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা দেখতে পান—মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না সেখানে।
ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্দেশ্যই ছিল প্রতারণা
দুদক সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন নামে একটি সিসি ঋণ (জামানতের মাধ্যমে লোন) হিসাব খোলা হয়। আর প্রতিষ্ঠানের নামে অংশিদারিত্ত্ব দলিল করা হয় একইবছরের ৩ জুন। যা ১ জুলাই কার্যকরিতা পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ অংশিদারিত্ব চুক্তির এক বছর আগেই অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১৭ এপ্রিল খোলা হয়েছিলো প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংক হিসাব। যা নিয়ম অনুযায়ী অংশিদারিত্ব চুক্তির পরে খোলার নিয়ম।
অপরদিকে, চুক্তিপত্রে দুই অংশীদারের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার কথা উল্লেখ থাকলেও ব্যাংক হিসাব খোলার ফর্মে ‘একজন হিসাব পরিচালনা করবেন’ বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ‘মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন’ নামে ভুয়া হিসাব খোলেন।
টাকা আত্মসাৎ করে চাকরিও হারান
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মামলার ৪ নম্বর আসামি ইকবাল হোসেন ওই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ গ্রহণের জন্য তার মালিকানাধীন ভূমিসহ চার তলা একটি ভবন বন্ধক রাখেন। ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের সিডিএ এভিনিউ শাখা ‘মেসার্স এইচ এইচ কর্পোরেশন’কে ৮ কোটি টাকা কম্পোজিট ঋণের সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিকবার ঋণের লিমিট নবায়ন করেও সবশেষ ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করে।
আবার লোকাল ও ফরেন এলসি খুলে পরবর্তীতে এলসিগুলো এলটিআর ও পিএডিতে রুপান্তর দেখিয়ে ঋণের টাকা ডিসভার্সড করে আসামিরা ব্যাংকের ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার টাকা লোপাট করে। পরবর্তীতে এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৩ সালের ৯ জুন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম চেীধুরী ও কাঞ্চন কুমার দে, দুজনেরই চাকরি চলে যায়।
জামানতের মূল্য বৃদ্ধি করে বাড়ানো হয় ঋণসীমা
২০০৮ সালের ২৮ মে আসামিরা বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য দেখায় ৪ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা দেখায়। ওই একই সম্পত্তি ২০১০ সালে মূল্য দেখানো হয় ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। আবার ২০০৮ সালে গোডাউনে স্টক পণ্য প্রাথমিক সিকিউরিটি বাবদ মূল্য ১০ কোটি টাকা উল্লেখ করলেও সেই একই পণ্যের মূল্য ২০১০ সালে দেখানো হয় ২৪ কোটি ৮ লাখ টাকা। এভাবেই জামানতের মূল্য বৃদ্ধি করে আসামিরা ঋণসীমা বৃদ্ধি করে এবং ঋণ ডিসভার্সড করে।
২০১১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখায় মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ৩টি লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর), ৬টি পেইড এগেইনস্ট ডকুমেন্টস (পিএডি) এবং একটি ক্রেডিট (সিসি) (হাইপো) হিসাবসহ মোট ১০টি হিসাব খোলা হয়। আর এসব হিসাবের মাধ্যমে আসামিরা ধারাবাহিকভাবে এলসি খোলার নামে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণের সুবিধা গ্রহণ করে সময়মত পরিশোধ করেননি।
তাই দুদক এজাহারে মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশনের নামে ভুয়া হিসাব বানিয়ে আসামি ইকবাল হোসেনের সম্পত্তিকে ব্যবহার করে ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনে বার বার মূল্য বৃদ্ধি করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ শাখার ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনে। একইসাথে দন্ডবিধির ৪০৯/১০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
মামলার বিষয়টি সিভয়েস২৪কে নিশ্চিত করেছেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত। তিনি বলেন, প্রতারণার উদ্দেশ্যে পরস্পর সহযোগিতা ও যোগসাজশ করে আবদুস সবুর চেীধুরীর নাম ব্যবহার করে মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ভুয়া অংশীদারি চুক্তিপত্র, ব্যাংক একাউন্ট ও জাল কাগজপত্র বানিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক হতে ২০০৭ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০টি হিসাবের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চারজনের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা হয়েছে। মামলা তদন্তকালে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা আইন অনুযায়ী আমলে নেওয়া হবে।