- আফতাব উদ্দিন।
সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া, যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কারচুপি, অবৈধ সংযোগ দিয়ে লাইন থেকে বিদ্যুৎ চুরি, সরকারি জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণসহ কোথাও কোনো অনিয়ম দেখলে দ্রুততার সাথে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেন সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আসা অর্থদন্ড বা জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়। সাধারণ মানুষের ধারণা, জরিমানার টাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা ওই সংস্থা পান, তা নাহলে টাকাটা যায় কোথায় ?
সাধারণ মানুষের এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কথা হয় বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে। তাদের মতে, জরিমানার টাকা কেউ রাখতে পারে না। খরচও করতে পারে না। এসব টাকা যথাযথ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়ে যায়। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নগরীতে অভিযান চালিয়ে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত (আদালত-১২) জরিমানা আদায় করেছে ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা।
বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মুক্তার পূর্বদেশকে বলেন, জরিমানার এসব টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে দিই। এমনকি দিনের জরিমানা দিনেই জমা হয়ে যায়।
গত ৭ মাসে ২৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের ৩১৮টি মামলায় ৪৩ লাখ ৩৯ হাজার ১৮৭ টাকা জরিমানা ও এক কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৭৯ টাকা বকেয়া আদায় করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. সহিদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (বিদ্যুৎ) আদালতের মাধ্যমে জরিমানা ও বকেয়া টাকা আদায় করা হয়। জরিমানা ও বকেয়ার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রেজারিতে জমা হয়ে যায়।
আবার সড়কে কোনো অনিয়ম দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট পরিবহনকে পুলিশ এসে মামলার একটা কাগজ ধরিয়ে দেন। একইসাথে ওই পরিবহনের কাগজপত্রগুলো কর্মকর্তা জব্দ করে নেন। যা পরে জরিমানা দিয়ে পুনরায় আনতে হয়। অধিকাংশ মোটরসাইকেল ও গাড়িচালক এমন ধারণা পোষণ করেন। অন্যান্য সংস্থার জরিমানার বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহ না থাকলেও পুলিশ বা ট্রাফিক সার্জেন্টের জরিমানা আদায়টা নিয়ে যেন সন্দেহ বেশি। গাড়িচালকসহ সাধারণ মানুষের এমন ধারণা পোষণ করায় ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারাও কিছুটা বিব্রত হন।
সার্জেন্টসহ ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা জানান, সড়কে আইন অমান্যের কারণে যাদেরকে মামলা দেয়া হয়, তারা ধরে নেয় যে মামলা থেকে ট্রাফিক টাকা পায়। সাধারণ মানুষ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও ‘কত পার্সেন্টেজ পাও’ এমন প্রশ্ন শুনতে হয়। কথাগুলো শুনলেই কি বলব তা নিয়ে বিব্রত হই।
পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় পূর্বদেশকে বলেন, মামলা থেকে সার্জেন্টদের পার্সেন্টেজ বা টাকা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা বলে ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিলে টাকা পায়, তারা না জেনে কথাটা বলে থাকে। এমন কোনো ব্যবস্থা ট্রাফিকে নেই।
পরিবহনে মামলা হওয়ার পর টাকা জমার পদ্ধতি দুটি। প্রথমত, সঙ্গে সঙ্গে জরিমানার টাকা নগদ জমা দিয়ে দায়িত্বরত সার্জেন্ট থেকে জব্দ হওয়া গাড়ির কাগজ বুঝে নেয়া আর দ্বিতীয়ত পুলিশের ডিসি অফিসে এসে টাকা জমা দিয়ে কাগজ নিয়ে যাওয়া।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশে মোটরযান আইনে মামলা হয়েছে ৭ লাখ ২০ হাজার ৮৯৩টি। এসব মামলা থেকে জরিমানা আদায় হয় ১৫৪ কোটি ১৫ লাখ ১১ হাজার ৪৮৮ টাকা। এর পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা সার্জেন্ট ও ট্রাফিক সদস্যরা জানান, সড়ক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অকারণেই আমাদেরকে দোষী হতে হচ্ছে। চালকরা ভাবেন, আমরা পার্সেন্টেজের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেই।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সার্জেন্ট কুমার বিশ্বজিৎ মজুমদার বলেন, আমার চাকরি জীবনে এই প্রশ্নটা যে কতবার শুনেছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। ট্রাফিক মামলা দিলে কমিশন বা পার্সেন্টেজ পায়- এটা অসত্য। কিছু মানুষ ইচ্ছে করে এই তথ্যটা ছড়ায়। পুলিশকে হেয়-প্রতিপন্ন করতে তারা এমনটা বলে বেড়ায়।
ট্রাফিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অপরাধ করলে তো ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ধরবেই। আর অভিযুক্ত রেহাই পাওয়ার জন্য নানা অজুহাত দিতে থাকবে। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে মামলায় জরিমানার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এ কারণে মামলা না নিয়ে চালকরা নানা অজুহাত দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা গ্রহণ করে ছেড়ে দেয়া হবে নাকি মামলা হবে, সে সিদ্ধান্ত ওই স্পটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার। কর্মকর্তা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করেন কি না সেটাও বলা মুশকিল। সবাই সমান নয়। কেউ কেউ অসৎভাবে চলে বলে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ অপবাদগুলো পুরো পুলিশ বাহিনীর ওপর আসে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বন্দর বিভাগের পরিদর্শক (প্রশাসন) রেজাউল করিম খান পূর্বদেশকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশকে হেয় করার জন্য ‘ভাগ বা পার্সেন্টেজ পায়’ এই প্রচারটা করা হয়। চাকরিতে যোগদানের পর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। মামলায় আদায় হওয়া জরিমানা থেকে পার্সেন্টেজ পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা পুলিশে নেই।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এনএম নাসিরুদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, পার্সেন্টেজের কোনো সুযোগ নেই। তা থাকলে সার্জেন্টরা দিনভর শুধু মামলাই দিতেন। আমরা মাসিক সভায় এমনও পাই, সারা মাসে একজন সার্জেন্ট কোনো মামলাই দেননি। শূন্য মামলার সার্জেন্টদের আবার চিঠি দিয়ে তিরস্কার করা হয়। কেননা, আমাদের এখানে সড়কে এত বেশি আইন অমান্য হয়, দায়িত্ব পালনকালে কোনো সার্জেন্ট আইন অমান্যকারী যানবাহন পাবেন না এটা হতে পারে না। অন্যদিকে এতে তার দায়িত্ব পালনে কিংবা সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগে শৈথিল্য প্রদর্শনের পরিচয় বহন করে।