ডিসেম্বর ৪, ২০২৪ ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি’র নতুন কমিটি

কেউ বলছেন হাটহাজারী কমিটি কেউ বলছেন চার নেতার কমিটি,বঞ্চিতরা বলছেন উড়ে এসে জুড়ে বসা কমিটি।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পরপরই বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। সদ্য ঘোষিত কমিটিকে কেউ ‘হাটহাজারী কমিটি’, কেউ ‘চার নেতার কমিটি, আবার কেউ ‘উড়ে আসা জুড়ে বসা কমিটি’ কিংবা ‘পার্সোনাল কমিটি’, কেউবা ‘সুসময়ের অতিথি কমিটি’, ‘মুরগির খোঁয়াড়’ বলছে। তবে হাইকমান্ডের তীক্ষ্ণ নজরের ভয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছেন সবাই। শাস্তি আতঙ্কে একেবারে চুপচাপ বঞ্চিতরা।

সোমবার (৪ নভেম্বর) বিকেলে ৫৩ সদস্যবিশিষ্ট ঘোষিত ওই কমিটিতে দলের শীর্ষ নেতাদের অনুসারীদের আধিক্য, আওয়ামী শাসন-শোষণের সময়ে দলের ভার বয়ে যাওয়া শাহাদাত-বক্কর-সুফিয়ান পন্থীদের দূরে সরানোর অভিযোগ ওঠেছে সবচেয়ে বেশি। এমনকি যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের ব্যবসায়িক পার্টনারসহ দুঃসময়ে না থাকা অনেকের ‘উড়ে এসে জুড়ে বসার’ খবর চাউর হয়েছে।

দীর্ঘ ১৬ বছর দলের আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেও পদ না পাওয়ায় অবাক হয়েছেন নগর বিএনপির এক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘কমিটি দেখে আমরা হতাশ। যারা দীর্ঘ ১৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন না তাদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। যদি সত্যিকারভবে এটা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কমিটি হতো তাহলে কমিটিটা এমন হতো না। এটা ব্যক্তি বিশেষের কমিটি; তাই এমন হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা এ কমিটি প্রত্যাখান করেছেন।

কমিটিতে চার নেতার অনুসারীর আধিক্য:

চট্টগ্রাম নগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিতে শীর্ষ চার বিএনপি নেতার ‘আধিপত্য’ বেশি। এর মধ্যে ৩৮ জনই তাদের অনুসারী। বাকি ১১ জনের মধ্যে কয়েকজন অন্য নেতার শিষ্য এবং ‘যোগ্য’ হিসেবে কমিটিতে স্থান পেয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩ জন, বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর ৯ জন, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর ৮ জন, সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের ৩ জন এবং এরশাদ-নাজিমের যৌথ পছন্দের আরো ৫ জন অনুসারী পদ পেয়েছেন। এছাড়া, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের ২ জন, নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের ২ জন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের দুজনসহ ‘যোগ্য’ ও ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ কয়েকজনও পদ পেয়েছেন কমিটিতে। বিএনপির একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩ জন : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩ অনুসারীর মধ্যে ছয়জন যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সাতজন সদস্য হিসেবে আছেন। তারা হলেন— যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ মিয়া ভোলা, এম এ আজিজ, এস এম সাইফুল আলম, সাফিকুর রহমান স্বপন, শাহ আলম, মনজুরুল আলম মঞ্জু এবং সদস্য পদে অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভূঁইয়া, জয়নাল আবেদীন জিয়া, আবুল হাসেম, মশিউল আলম স্বপন, গাজী আইয়ুব, হানিফ সওদাগর ও সরফরাজ কাদের চৌধুরী রাসেল।

মীর হেলালের ৯ : বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর ৯ জনের মধ্যে তিনজন যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ৬ জন সদস্য পদে জায়গা পেয়েছেন। এর মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ আজম উদ্দিন, কাজী বেলাল উদ্দীন, হারুন জামান এবং সদস্য পদে ইকবাল চৌধুরী, এম. এম হান্নান, এস. এম আবুল ফয়েজ, মো. মহসিন, মাহবুব রানা ও মোহাম্মদ আবু মুসা।

এরশাদ উল্লাহর ৮ : নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর ৮ জন পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক নিয়াজ মোহাম্মদ খান, আর ইউ চৌধুরী শাহিন, আহম্মেদুল আলম চৌধুরী এবং সদস্য পদে সৈয়দ শিহাব উদ্দীন আলম, মো. জাফর আহম্মদ, মোহাম্মদ আজম, মো. আশ্রাফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ ইউছুপ।

নাজিমুর রহমানের ৩ : নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের ৩ জনের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আলম খাজা (দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) এবং সদস্য পদে মামুনুল ইসলাম হুমায়ুন ও নুরু উদ্দিন হোসেন নুরু।

এরশাদ-নাজিমের যৌথ পছন্দের ৫ : নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ এবং সদস্য সচিব নাজিমুর রমহানের অনুসারী হিসেবে কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন আরো ৫ জন। তারা হলেন— যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব উদ্দীন মুবিন (প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত) এবং সদস্য হিসেবে অধ্যাপক নুরুল আলম রাজু, মুজিবুল হক, মো. খোরশেদুল আলম ও মো. ইসমাইল বালি কমিটিতে পদ পেয়েছেন।

আব্দুল্লাহ আল নোমানের ২ : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের দুই অনুসারীর কমিটিতে স্থান হয়েছে। তারা হলেন— যুগ্ম আহ্বায়ক পদে অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার এবং সদস্য মোশাররফ হোসেন ডিপটি।

ডা. শাহাদাত হোসেনের ২ : নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের ২ জন সদস্য পদে কমিটিতে রয়েছেন। তারা হলেন— গাজী সিরাজ উল্লাহ ও কামরুল ইসলাম।

আবু সুফিয়ানের ২ : দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের ২ জন অনুসারীর মধ্যে ইসকান্দর মির্জা ও আনোয়ার হোসেন লিপুকে সদস্য পদে রাখা হয়েছে।

এছাড়া, ‘ত্যাগী’ নেতা হিসেবে ইয়াছিন চৌধুরী লিটনকে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে কমিটিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, বাকি চারজনের মধ্যে সদস্য পদে জাহাঙ্গীর আলম দুলাল, মো. সালাউদ্দিন, এ. কে. খান ও এম. এ সবুর কোন নেতার অনুসারী তা জানা যায়নি।

কমিটি প্রসঙ্গে নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্ল্যাহ ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানকে সোমবার সন্ধ্যা থেকে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি। পরে রাতের ফিরতি কলে নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘এটা তো টেম্পোরারি কমিটি। পরবর্তী কমিটিতে হয়তো জায়গা হবে। আর এখানে (আহ্বায়ক কমিটি) তো জায়গা কম।’

কমিটিতে শুধু কয়েকজন নেতার অনুসারিদের রাখা হয়েছে উল্লেখ করা হলে ‘এমনটা হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

এক নেতার দুই পদ

সাংগঠনিক নিয়মানুযায়ী, অঙ্গসংগঠনের পদে থাকা কারো পদে আসার সুযোগ নেই। তবু নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতির পদে থাকা মো. ইউসুফকে করা হয়েছে সদস্য। নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এইচ এম রাশেদ খান ও বেলায়েত হোসেন বুলু।

বাদ পড়েছেন আগের কমিটির অনেকে

ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাশেম বক্করের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান, সদস্য শামসুল আলম ও মোহাম্মদ আলী, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাহবুব আলম, মোহরা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী শুলকবহর ওয়ার্ডের আশরাফ চৌধুরী বাদ পড়েছেন কমিটি থেকে।

কমিটিতে আ.লীগ নেতার ব্যবসায়িক ‘পার্টনার’

বিগত ১৭ বছর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর বাবরের সাথে রেলওয়েতে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে নতুন কমিটিতে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আজম খাজা ও সদস্য নুর উদ্দিন হোসেন নুরুর বিরুদ্ধে।

অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার নেতাও কমিটিতে!

অস্ত্রসহ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া যুবদল নেতা মো. মহসিনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে নগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিতে। বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে।

দপ্তরের দায়িত্ব সামলানো ইদ্রিস বাদ পড়ায় অবাক সবাই

আওয়ামী শাসনামলে চারদিকে যখন ধরপাকড় তখন নিয়মিত গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে দলকে তুলে ধরেছেন বিলুপ্ত কমিটির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. ইদ্রিস আলী। এরপর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় দপ্তরের দায়িত্ব সামলিয়েছেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। শাহাদাতের মেয়র নির্বাচনের সময়ও মিডিয়া সেলের প্রধান ছিলেন তিনি। এবার তাকে একেবারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ‘দূরে’। তার পদ না পাওয়া নিয়ে অবাক নেতাকর্মী সবাই। সবার ধারণা ছিলো, তিনি আবারো আগের দায়িত্বে ফিরবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইদ্রিস আলী তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করেছেন। নগরের পাঁচলাইশ থানার চাইল্যাতলী ইউনিট ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। এরপর পাঁচলাইশ ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের নির্বাচিত সম্পাদক। পরে বৃহত্তর পাঁচলাইশ থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। এরপর বায়েজিদ থানা ছাত্রদলের নির্বাচিত সম্পাদক। পরে মহানগর ছাত্রদলের যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। একে একে ওয়ার্ড বিএনপির দপ্তর সম্পাদক, থানা বিএনপির প্রচার সম্পাদক, বায়েজিদ থানা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক, নগরের সহ-দপ্তরের সম্পাদকের পর দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। তার নামে আছে রাজনৈতিক মামলা, খেটেছেন জেলও।

এছাড়া, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মিডিয়া সেলের প্রধান ছিলেন ইদ্রিস। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ডা. শাহাদাত হোসেনের মিডিয়া সেলের প্রধান করা হয় তাকে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সারাদেশে ইন্টারনেট বিঘ্ন থাকলেও তিনি দলীয় নিউজ সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছেন অনেক ‘কাঠখড়’ পুড়িয়ে। তবে দুঃসময়ে কাজ করা এমন নেতাকে ‘সুসময়ে’ করা হয়নি মূল্যায়ন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ইদ্রিস আলী কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

সাম্প্রতিক